বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

গাড়ির কাগজপত্র নবায়নে করের বোঝা: মালিকদের অনীহা, সরকারের নতুন উদ্যোগ

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২৮ জানুয়ারী ২০২৫ | ১২:০১ পূর্বাহ্ন


সরকার মোটরযান বা মোটরগাড়ির কাগজপত্র ও ফিটনেস হালনাগাদে জরিমানা মওকুফ করলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না। রাস্তায় প্রতিনিয়ত কাগজ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, জরিমানা মওকুফ করা হলেও অতিরিক্ত করের কারণে গাড়ির মালিকরা কাগজপত্র হালনাগাদ করছেন না। সিসিভেদে (ইঞ্জিন ক্ষমতা) একটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্ধারিত যে ফি দিতে হয়, তার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ অগ্রিম কর দিতে হয়। মালিকের একাধিক গাড়ি থাকলে যুক্ত হয় পরিবেশ সারচার্জ।

বিশাল অংকের এই করের ভয়ে বিআরটিএ জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিলেও গাড়ির মালিকরা কাগজপত্র হালনাগাদে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।

সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে চলতি ও এর আগের অর্থবছরের (দুই বছরের) অগ্রিম কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। বাকি অর্থবছরগুলোর বকেয়া কর মোটরযান মালিকের রিটার্ন দাখিলের সময় আদায়ের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

এতে এনবিআরের অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট, পরিবেশ সারচার্জ, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি আদায় বাড়বে, মোটরযান কর ও ফি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আদায় হবে এবং ফিটনেসবিহীন মোটরযানের সংখ্যা কমবে বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।

এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, একসঙ্গে পাঁচ বছরের কাগজপত্র নবায়ন করতে গেলে করের জন্য স্বাভাবিকভাবে অসুবিধায় পড়বেন পরিবহন মালিকরা। প্রতি বছর কাগজপত্র নবায়ন করলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুরোনো বকেয়া পরিশোধ না করলে দুই বছরের কর নেওয়ার সুবিধা দেওয়া যাবে না। মন্ত্রণালয়ের চিঠি বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিআরটিএ মোটরযান কর ও ফি হিসেবে দুই হাজার ২১৪ কোটি টাকা এবং এনবিআর নির্ধারিত কর হিসেবে দুই হাজার ৫০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে একই সফটওয়্যারে এনবিআরের পরিবেশ সারচার্জ আদায় শুরু হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ বা নবায়নে বিআরটিএ’র কর ও ফি’র চেয়ে এনবিআর নির্ধারিত কর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ১৫০০ সিসির গাড়ির জন্য বিআরটিএ’র ফি ৭,৪০৭ টাকা হলেও এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম কর ২৫,০০০ টাকা।

একাধিক গাড়ি থাকলে দিতে হয় পরিবেশ সারচার্জ। ১৫০০ সিসির গাড়ির সঙ্গে ২০০০ সিসির জিপ থাকলে বিআরটিএ’র ফি দিতে হবে ১৪,৮১৪ টাকা। সঙ্গে দুটি গাড়িতে অগ্রিম কর ১,০০,০০০ টাকা ও পরিবেশ সারচার্জ ৫০,০০০ টাকাসহ মোট কর দিতে হয় ১,৬৪,৮১৪ টাকা।

মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও পরিবেশ দূষণ। মূলত বিআরটিএ’র জরিমানা ও করের ভয়ে কাগজপত্র নবায়ন করেন না অনেক মালিক।

ফিটনেসবিহীন গাড়ি বাতিল ও মোটরযানের মালিকদের কাগজপত্র নবায়নে আগ্রহী করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেওয়ার পর একাধিকবার বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি দিলেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।

এনবিআর নির্ধারিত করের কারণে সাড়া মেলেনি বলে মনে করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কারণ, বিআরটিএ’র অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যারে মোটরযানের কর ও ফি জমা প্রদান করতে গেলে আগের অর্থবছরের বকেয়া আয়কর পরিশোধ করতে হয়, যা আর্থিক বিবেচনায় বিআরটিএ’র সেবামূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

উদাহরণ হিসেবে চিঠিতে বলা হয়, ১৫০০ সিসির গাড়ির মালিক পাঁচ বছর কাগজপত্র নবায়ন না করলে, নবায়নের সময় বিআরটিএ’র ফি ৩৭,০৩৫ টাকা এবং অগ্রিম কর ১,২৫,০০০ টাকা। একাধিক গাড়ি থাকলে বিপুল পরিমাণ সারচার্জ দিতে হবে। ৩৫০০ সিসির অধিক গাড়ির অগ্রিম আয়কর ২,০০,০০০ টাকা, একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে ৩,৫০,০০০ টাকা। অথচ এ গাড়িতে বিআরটিএ’র ফি মাত্র ৫,০০০ টাকা।

এনবিআর সূত্রমতে, আয়কর আইন- ২০২৩ এর ধারা ১৫৩ অনুযায়ী, গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় আয়কর রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকার (পিএসআর) জমা না দিলে অগ্রিম করের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ‘মোটরযান মালিকদের উৎসাহ’ দিতে এনবিআরের কাছে দুই অর্থবছরের কর আদায়ের একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। খেলাপি মোটরযান মালিকদের কাগজপত্র নবায়নের ক্ষেত্রে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর ও এর আগের এক বছরের (২০২৩-২৪) বকেয়া অগ্রিম কর আদায়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রিক মোটরযানের পরিবেশ সারচার্জ মওকুফ করারও অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।