
আজকের সকালটা শুরু হলো একরাশ উদ্বেগ আর আশঙ্কার কালো মেঘ নিয়ে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত আটজন বেসামরিক নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং পয়ঁত্রিশ জনের আহতের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নিহতদের মধ্যে দুটি নিষ্পাপ শিশুও রয়েছে। এই সংবাদ আমাদের আবারও সেই চিরন্তন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় – এই নিরীহ শিশুদের, এই সাধারণ মানুষগুলোর অপরাধ কী ছিল? কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তারাও তো ছিলেন এমনই নিরপরাধ। তাহলে কেন এই হত্যাযজ্ঞ? কেন এই যুদ্ধের দামামা, যা কেবল ধ্বংস আর মৃত্যু ডেকে আনে?
সংবাদ সংস্থাগুলোর বরাতে জানা যাচ্ছে, ৭ই মে, ২০২৫-এর ভোরের আলো ফোটার আগেই ভারত পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোট ও বাহাওয়ালপুর এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের একাধিক স্থানসহ মোট ছয়টি জায়গায় তথাকথিত “অপারেশন সিঁদুর” পরিচালনা করে। এর জবাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে, যার মধ্যে রাফাল ও সুখোই-৩০ এর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানও রয়েছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই পাল্টা হামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। উভয়পক্ষ থেকেই নিজেদের পদক্ষেপকে আত্মরক্ষামূলক এবং প্রতিপক্ষের আগ্রাসনের জবাব হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ভারতের দাবি, তারা সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, হামলায় মসজিদসহ বেসামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নিরীহ মানুষ হতাহত হয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে, তা হলো সাধারণ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা।
যুদ্ধের ভয়াবহতা কোনো একক ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। এর বিষাক্ত ছোবল ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। যে শিশুরা আজ গোলাগুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠছে, যাদের চোখের সামনে তাদের প্রিয়জনদের রক্ত ঝরছে, তাদের কচি মনে যে আতঙ্ক ও ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছে, তার পরিণতি এই সমাজ ও বিশ্বকে দীর্ঘকাল বহন করতে হবে। যুদ্ধের উন্মাদনায় নীতিনির্ধারকেরা হয়তো কৌশলগত জয়ের হিসাব কষেন, কিন্তু মানবতার নিক্তিতে প্রতিটি মৃত্যুই এক একটি অপূরণীয় ক্ষতি। যে জীবন একবার চলে যায়, তা পৃথিবীর কোনো সম্পদ বা ক্ষমতার বিনিময়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
এই ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মানবতাবাদী লেখক থমাস কেনিয়েলির উপন্যাস অবলম্বনে স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর কথা মনে পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলার যেভাবে প্রথমে ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্যে ইহুদিদের নিজের কারখানায় নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে নাৎসিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ দেখে তাদের জীবন বাঁচাতে নিজের সর্বস্ব বাজি রেখেছিলেন, সেই কাহিনী মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিন্ডলারের তৈরি করা সেই তালিকা, যা ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ নামে খ্যাত, এগারোশ’ ইহুদিকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সিনেমার শেষে সেই বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের দেওয়া সোনার আংটিতে হিব্রু ভাষায় লেখা ছিল, “যিনি একজনের জীবন বাঁচান তিনি সমস্ত পৃথিবীকে বাঁচান”। এই বার্তা কেবল একটি সিনেমার সংলাপ নয়, এটি মানবধর্মের শাশ্বত বাণী। পবিত্র কোরআনেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে – একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচানোর সমতুল্য।
কিন্তু আজ আমরা কী দেখছি? ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, ভূখণ্ডের নামে, রাজনৈতিক স্বার্থের নামে মানুষ হত্যা এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের এই সাম্প্রতিক সংঘাত তারই একটি দুঃখজনক প্রতিফলন। একটি সন্ত্রাসী হামলার জবাবে আরেকটি সামরিক অভিযান, আর তার জেরে আরও নিরীহ মানুষের প্রাণহানি – এই চক্র থেকে বের হতে না পারলে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না, বরং তা নতুন নতুন সংকটের জন্ম দেয়। সম্পদ ধ্বংস হয়, অর্থনীতি পঙ্গু হয়, সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসা হারিয়ে যায়। যে অর্থ অস্ত্র কেনার পেছনে ব্যয় হয়, তা যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা দারিদ্র্য বিমোচনে খরচ করা হতো, তাহলে পৃথিবীটা হয়তো আরও সুন্দর হতো।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উভয় দেশকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্কের মতো দেশগুলোও উত্তেজনা প্রশমনে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে। এটি আশার কথা। কিন্তু মূল দায়িত্ব ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে একটি ছোট স্ফুলিঙ্গও ভয়াবহ দাবানলে রূপ নিতে পারে, যার পরিণতি হবে অকল্পনীয়। পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া, ফ্লাইট বাতিল বা পথ পরিবর্তন করা – এগুলো কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নির্দেশ করে না। এটি একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির আলামত, যা গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে প্রয়োজন প্রতিহিংসার পরিবর্তে সুবিবেচনা ও মানবিক বোধের। যে কোনো আগ্রাসন বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিন্দনীয়, তবে তার প্রতিকার আরও বড় পরিসরে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে না। আলোচনার মাধ্যমেই সকল বিরোধের নিষ্পত্তি সম্ভব। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা আর সহনশীলতার।
আসুন, আমরা সবাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। নিহত প্রতিটি প্রাণের জন্য শোক প্রকাশ করি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। ঘৃণা আর বিদ্বেষের পরিবর্তে ভালোবাসার কথা বলি, মানবতার জয়গান গাই। এই পৃথিবী এক অপার সম্ভাবনার জায়গা, যুদ্ধ দিয়ে সেই সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, তারা উপলব্ধি করুক যে ক্ষমতার দম্ভ নয়, মানবিকতাই ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সেই বোধ দিন, যা দিয়ে আমরা এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে বেরিয়ে এসে এক শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি। কারণ, মানবিক বোধ জাগ্রত না হলে এই দেশ বা পৃথিবীকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।