বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

এই পৃথিবী শান্ত হবে কবে?

সাইফুল আযম | প্রকাশিতঃ ১৪ মে ২০২৫ | ৫:০১ অপরাহ্ন


কখন এই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে শান্ত হবে, সেই প্রশ্ন আজ আমাদের সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের এই যে সুন্দর পৃথিবী, আমাদের নীল রঙের গ্রহ, এটা শুধু আমাদের, অর্থাৎ মানুষের একার সম্পত্তি নয় – এই গভীর সত্যটি অন্তরে ধারণ করা, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এখনকার সময়ে অত্যন্ত জরুরি। আমরা প্রায়শই এক বিরাট ভ্রান্তির মধ্যে বাস করি, যখন অবলীলায় ভেবে নিই যে মহান সৃষ্টিকর্তা এই সুবিশাল বসুন্ধরা শুধুমাত্র আমাদের, মানুষের ভোগদখলের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এই ধারণাটি আমাদের চিন্তা ও কর্মকে বহুলাংশে ভুল পথে চালিত করে। কিন্তু বাস্তবতা এর থেকে অনেক ব্যাপক, অনেক মহৎ এবং অনেক বেশি পরস্পর সংযুক্ত। এই পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে সমস্ত জীবজগতের, প্রতিটি প্রাণের সম্মিলিত আবাস।

সুউচ্চ পর্বতমালা যা মেঘেদের ছুঁয়ে যায় আর আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্মাণে সাহায্য করে, কলকল রবে বয়ে চলা নদী যা তৃষ্ণা মিটিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয় উর্বরতা, অতলান্ত মহাসাগর যা বুকে ধারণ করে অসীম রহস্য আর পৃথিবীর জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে, স্নিগ্ধ ছায়া দেওয়া সুবিশাল বৃক্ষরাজি যা আমাদের শ্বাসের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে আর মাটির ক্ষয় রোধ করে, সেই বৃক্ষের শাখায় নির্ভয়ে বিচরণ করা নানা রঙের পশুপাখি যারা প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সাগরের নীলাভ গভীরে সাঁতরে বেড়ানো বিচিত্র সব প্রাণী, দুর্গম পাহাড়ের কোলে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য জীবজন্তু, এমনকি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে মাটির নিচে নীরবে কাজ করে যাওয়া লক্ষ কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ ও অণুজীব – এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার, এর সম্পদ ভোগ করার সমান ও ন্যায্য অধিকার রয়েছে তাদের সকলের। প্রতিটি প্রাণের, তা যত ছোট বা যত বড়ই হোক না কেন, এই পৃথিবীর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে সচল ও সুস্থ রাখার জন্য নিজস্ব নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে, যা আমরা অনেক সময়ই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই বা জেনেও না জানার ভান করি। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে গেলে তার পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছি।

কিন্তু আমরা, তথাকথিত সৃষ্টির সেরা জীব মানুষেরা, প্রতিনিয়ত নিজেদের অসীম লোভ আর স্বল্পমেয়াদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই অধিকার নির্দ্বিধায় খর্ব করে চলেছি। আমরা নির্বিচারে, অকারণে সবুজ বনানী উজাড় করে ফেলছি, কেটে ফেলছি প্রাচীন সব গাছপালা, ধ্বংস করছি পাহাড়। এর ফলে শুধু যে অসংখ্য পশুপাখি ও পতঙ্গের নিরাপদ আবাসস্থলই নষ্ট হচ্ছে তাই নয়, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে আমাদের জলবায়ুর উপর, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, বৃদ্ধি পাচ্ছে ভূমিক্ষয় এবং মরুকরণের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন প্রকারের শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক আবর্জনা, রাসায়নিক পদার্থ নির্বিচারে ফেলে আমরা সাগরকে এক বিশাল আস্তাকুঁড়ে পরিণত করছি। এর মারাত্মক বিষাক্ত প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবনচক্রের উপর, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে, বহু প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে। কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও নাগরিক জীবনের নানা ক্ষতিকর পদার্থ সরাসরি নদীতে মিশে নদীর স্বচ্ছ জলকে বিষাক্ত করে তুলছে, ধ্বংস করছে নদীর প্রাণবৈচিত্র্য ও তার পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্রকে। যে নদী একসময় ছিল জীবনের উৎস, আজ তা বহু ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে মরণের ফাঁদে।

এখানেই আমাদের ধ্বংসলীলা থেমে নেই। মানুষ যেন আরও ভয়ংকর সব খেলায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধরনের গণবিধ্বংসী জৈব অস্ত্র, বিধ্বংসী রাসায়নিক বোমা, দূরপাল্লার মিসাইল, এমনকি মানবসভ্যতাকে মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এমন পারমাণবিক বোমার মতো ভয়ংকর সব অস্ত্রের প্রতিযোগিতা আর তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রতিনিয়ত এই পৃথিবীর বুকে চালানো হচ্ছে। এই সব পরীক্ষার ফলে পরিবেশে যে দীর্ঘমেয়াদী বিষক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তার সম্পূর্ণ চিত্র হয়তো আমাদের এখনও অজানাই রয়ে গেছে। উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে আমরা কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটাতে চেষ্টা করছি, প্রকৃতির স্বাভাবিক জলচক্রকে ব্যাহত করছি, যা অদূর ভবিষ্যতে মানুষসহ সমগ্র প্রাণিজগতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা আসলে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ভাঙার এক অসুস্থ, আত্মঘাতী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। প্রকৃতিকে তার আপন খেয়ালে, তার নিজস্ব সুশৃঙ্খল নিয়মে চলতে না দেওয়ার এই যে উদ্ধত প্রবণতা, তার নির্মম ফল কিন্তু আমাদের সকলকেই, ধনী-দরিদ্র, উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে, ভোগ করতে হচ্ছে। মানুষ থেকে শুরু করে সাগরের অতিক্ষুদ্র শৈবাল কিংবা মাটির কেঁচো পর্যন্ত কেউই এর বিধ্বংসী প্রভাবের বাইরে নয়।

এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ, প্রকৃতিও যেন আমাদের এই লাগামছাড়া অত্যাচার আর অবিচারের প্রতি তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে তার চরম বিরূপ আচরণ প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বজুড়ে ঘন ঘন অনাকাঙ্ক্ষিত পাহাড় ধস, যা মুহূর্তে গ্রাস করছে জনপদ আর কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। কোথাও মরসুমের খামখেয়ালিপনায় অতিবৃষ্টিতে সৃষ্টি হচ্ছে প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, ফসল আর মানুষের স্বপ্ন। আবার অন্য কোথাও দীর্ঘকালীন অনাবৃষ্টির কারণে দেখা দিচ্ছে তীব্র খরা, শুকিয়ে যাচ্ছে নদীনালা, ফেটে চৌচির হচ্ছে ফসলের মাঠ, সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট। ভূমিকম্পের ক্রমবর্ধমান আঘাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত বারেবারে কেঁপে উঠছে, সুনামির করাল গ্রাসে মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হচ্ছে শান্ত উপকূলীয় জীবন, আর ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন, হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হচ্ছে জনজীবন ও অর্থনীতি।

২০২০ সালে হানা দেওয়া করোনা মহামারীর বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহতা, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা প্রকৃতির রুদ্ররোষের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ মাত্র। সেই দুঃসহ স্মৃতির রেশ কাটতে না কাটতেই আমরা দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বিধ্বংসী বন্যা, আবার কোথাও অনাবৃষ্টির কারণে দাবানলের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে লক্ষ লক্ষ হেক্টর বনভূমি আর কেড়ে নিয়েছে অগণিত বন্যপ্রাণ। এমনকি যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মূলত মরুভূমির দেশ হিসেবে পরিচিত, সেখানেও আমরা অপ্রত্যাশিত ও ভয়াবহ বন্যা এবং জলবদ্ধতা দেখতে পেয়েছি। প্রকৃতি যেন তার নানা রূপের অভিব্যক্তির মাধ্যমে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বারংবার দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি হয়তো অনেক কিছু সহ্য করেন, অনেক ছাড় দেন, কিন্তু চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করলে তিনি কাউকেই ছেড়ে দেন না।

এর পাশাপাশি, মানবসৃষ্ট সংকটগুলোও পৃথিবীকে করে তুলেছে আরও বেশি অশান্ত। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিরামহীনভাবে চলতে থাকা সশস্ত্র সংঘাত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি – এসকলের কারণে চারদিকে শুধু বারুদের গন্ধ, মানুষের আর্তনাদ, স্বজন হারানোর বুকফাটা কান্না আর ছিন্নভিন্ন মানবতা। মৃত্যুর এই ভয়াল মিছিল যেন কিছুতেই থামতে চাইছে না। এই যুদ্ধবিগ্রহ কেবল মানুষের জীবনই কেড়ে নিচ্ছে না, ধ্বংস করছে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামো। অন্যদিকে, ‘এল নিনো’ আর ‘লা নিনার’ মতো জটিল প্রাকৃতিক জলবায়ু সংক্রান্ত ঘটনার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা কৃষিকাজ থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই ফেলছে গভীর নেতিবাচক প্রভাব। বিগত বছরগুলোতে আমরা আকস্মিক বিমান দুর্ঘটনা এবং বিভিন্ন স্থানে অপ্রত্যাশিত দাবানলের মতো ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমাদের ব্যথিত ও শঙ্কিত করে তোলে। স্বজনদের অন্তহীন কান্না আর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

এখন সত্যিই সময় এসেছে আমাদের গভীর আত্মোপলব্ধির, আমাদের সম্মিলিত বোধোদয়ের। আর বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। আসুন, আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখি, তার প্রতি যত্নশীল হই। প্রকৃতিকে তার আপন ছন্দে, তার নিজস্ব সুশৃঙ্খল নিয়মে চলতে দিই। প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি, তা যত ক্ষুদ্র বা নগণ্যই হোক না কেন, আমাদের হৃদয়ে সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রদর্শন করি এবং প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়মগুলোকে শ্রদ্ধাভরে মেনে চলি। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে এই সুন্দর পৃথিবী নামক গ্রহটির সার্বিক সুরক্ষা এবং এর সকল প্রাণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি। আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, এই পৃথিবী আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে সাবধানে লালিত এক অমূল্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমানত এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের তা আরও সুন্দর, আরও সুস্থ ও সুরক্ষিত অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার এক পবিত্র দায়িত্ব আমাদেরই বহন করতে হবে।

আসুন, আমরা সকলে মিলে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য, আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, একটি সবুজ, সুস্থ, সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার করি। এমন এক পৃথিবী, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের শত্রু নয়, বরং পরিপূরক হিসেবে পরম শান্তিতে পাশাপাশি সহাবস্থান করবে। এমন এক পৃথিবী, যেখানে কোনো সংঘাত থাকবে না, কোনো হিংসা বা বিদ্বেষ থাকবে না, থাকবে শুধু অফুরন্ত শান্তি, ভালোবাসা আর পারস্পরিক সম্প্রীতি। এই পৃথিবী আবার অবশ্যই শান্ত হবে, এর হারানো গৌরব ফিরে পাবে, যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে সেই পরিবর্তন চাই এবং সেই মহৎ লক্ষ্যে একযোগে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। প্রকৃতির সবুজ রং আবার সতেজ হয়ে উঠবে, পাখির কলকাকলিতে আবার মুখরিত হবে আমাদের চারপাশ, নদীর জলধারা বয়ে চলবে স্বচ্ছন্দে তার আপন পথে আর সাগরের অসীম নীল জলরাশি হবে আরও গভীর, আরও প্রাণবন্ত – যদি আমরা আজ, এই মুহূর্ত থেকেই প্রকৃত অর্থে সচেতন হই এবং আমাদের জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনি। আর এই সম্মিলিত সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণই একদিন বয়ে আনবে সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি, ফিরিয়ে দেবে এই পৃথিবীর স্বাভাবিক ছন্দ ও তার স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য। এই গ্রহের প্রতিটি কোণে তখন ধ্বনিত হবে জীবনের জয়গান, শান্তির সুবাতাস।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।