বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

মনু মিয়ার ঘোড়া এবং এক নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি

সাইফুল আযম | প্রকাশিতঃ ২০ মে ২০২৫ | ৫:০৯ অপরাহ্ন


বাংলার শ্যামল প্রান্তরে, নরসুন্দা নদীর তীরে শান্ত স্নিগ্ধতায় ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন জনপদ – কিশোরগঞ্জ। এর বাতাসে মিশে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ঘ্রাণ। বজ্র কিশোর প্রমাণিক ও নন্দকিশোর প্রমাণিকের স্মৃতিধন্য এই শহরের নামকরণ যেন আজও তাঁদের অবদানের প্রতিচ্ছবি। ছোট্ট এই শহর, কিন্তু এর বুক জুড়ে ধারণ করে আছে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কত না স্মারক! এখানেই দিগন্তবিস্তৃত হয় বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈদগাহ, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ। ঈদের দিনে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত হয় এই প্রান্তর, সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব ধর্মীয় মেলবন্ধনের। বাতাসে ভেসে বেড়ায় ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি, যা ছড়িয়ে পড়ে দিক থেকে দিগন্তে।

শুধু তাই নয়, এই কিশোরগঞ্জের মাটিতেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপশালী শাসক সম্রাট ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত জঙ্গলবাড়ি। কালের সাক্ষী হয়ে থাকা এই স্থাপত্য যেন ফিসফিস করে শুনিয়ে যায় অতীতের বীরত্বগাথা। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত শাহ মোহাম্মদ মসজিদ আর চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির জানান দেয় এই অঞ্চলের মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরতা। প্রতিটি ইট, প্রতিটি কণা যেন নীরবে বয়ে বেড়ায় শত শত বছরের গল্প।

এই পুণ্যভূমি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য কীর্তিমান সন্তানের, যাঁরা আপন মহিমায় শুধু কিশোরগঞ্জকেই নয়, আলোকিত করেছেন সমগ্র বাংলাদেশকে। সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যাঁর লেখনী শিশুদের মনোজগতে বুনেছে কল্পনার রঙিন জাল। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়, যাঁর আবোল তাবোল আর হযবরল আজও আমাদের হাসায়, ভাবায়। তুলির আঁচড়ে জীবনের রং যিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী জয়নাল আবেদীনের জন্মও এই কিশোরগঞ্জে। দুঃসময়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া অকুতোভয় বীর, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্মভিটাও এই মাটি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে যিনি বিজ্ঞানমনস্কতা আর মহাকাশের অপার রহস্য উন্মোচনের আইডল, সেই প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক মো. আমিনুল হকের শেকড়ও এই কিশোরগঞ্জের মাটিতেই প্রোথিত। নব্বইয়ের দশকে যাঁর অভিনয় দখল করেছিল লক্ষ দর্শকের হৃদয়, সেই চলচ্চিত্র শিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চনের বাড়িও এই গর্বিত জেলায়। এমন আরও অসংখ্য গুণীজনের পদধূলিতে ধন্য এই কিশোরগঞ্জ।

কিন্তু এই সব খ্যাতি আর পরিচিতির আড়ালে, নীরবে-নিভৃতে বাস করতেন এক অন্যরকম মানুষ। এমন এক মানুষ, যাঁর জীবনের গল্প হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে না, কিন্তু মানবতার ইতিহাসে যাঁর অবদান ভাস্বর হয়ে থাকবে চিরকাল। তিনি হলেন পরোপকারী মনু মিয়া, আর তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ – তাঁর ‘অভাগা’ ঘোড়াটি। কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ছায়াঢাকা, পাখিডাকা আগলাপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। জীবনসায়াহ্নে উপনীত এই মানুষটির বয়স আজ ৭৬ বছর। এলাকার সবাই তাঁকে এক ডাকে চেনে – মনু মিয়া, নিঃস্বার্থ এক সেব্ৰতী।

জীবনের দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছর! হ্যাঁ, পুরো অর্ধশতাব্দীকাল ধরে মনু মিয়া এক আশ্চর্য মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিন হাজার আটান্নটি – সংখ্যাটি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে তিন হাজার আটান্নটি জীবনের পরিসমাপ্তি, স্বজন হারানোর বেদনা আর মনু মিয়ার নিঃশব্দ শ্রম ও সহমর্মিতা। কারও মৃত্যুর সংবাদ কানে আসা মাত্রই, দিন হোক বা রাত, ঝড় হোক বা বৃষ্টি, মনু মিয়া আর তাঁর বিশ্বস্ত ঘোড়াটি বেরিয়ে পড়তেন। ঘোড়ার পিঠে থাকত কবর খোঁড়ার যাবতীয় সরঞ্জাম – কোদাল, শাবল, বাঁশ কাটার দা। এই নীরব শোভাযাত্রা চলত সদ্য প্রয়াত মানুষটির শেষ আশ্রয়টুকু প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে। কোনো পারিশ্রমিকের প্রত্যাশা নয়, কেবলই এক গভীর মানবিক তাড়না থেকে তিনি এই কাজ করতেন। তাঁর ঘোড়াটি? সে তো শুধু একটি প্রাণী ছিল না, ছিল মনু মিয়ার সুখ-দুঃখের সাথী, তাঁর নীরব সহকর্মী। নিজের সন্তানের মতোই তিনি ভালোবাসতেন ঘোড়াটিকে, পরম মমতায় তার যত্ন নিতেন। মনিবের প্রতিটি ইঙ্গিত সে বুঝত, নীরবে অনুসরণ করত তাঁর পথ। কত অসংখ্যবার এই ঘোড়াটি মনু মিয়াকে বয়ে নিয়ে গেছে দূর থেকে দূরান্তরে, নতুন কবরের সন্ধানে!

কিন্তু কালের নিয়ম অমোঘ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেন মনু মিয়া। যে মানুষটি একদিন অপরের সেবায় ছিলেন সদাতৎপর, তিনিই আজ শয্যাশায়ী। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ভর্তি হলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। পেছনে, গ্রামের নিভৃত কোণে রেখে এলেন তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় ঘোড়াটিকে। হয়তো ভেবেছিলেন, সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবেন তার কাছে, আবার একসঙ্গে ছুটবেন মানবতার ডাকে।

কিন্তু হায়! নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! মনু মিয়ার অনুপস্থিতিই যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়াল নিরীহ, অবলা প্রাণীটির জন্য। কোন পাষণ্ড, কোন হৃদয়হীন মানুষ এমন নিষ্ঠুর কাজটি করতে পারল? কোন অভাগা মায়ের সন্তান সে, যার অন্তরে এতটুকুও দয়ামায়া নেই? যে ঘোড়াটি আজীবন কেবল মানুষের সেবাই করে গেল, যে ছিল এক পরোপকারী মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী, তাকেই কি না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো! বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে এই নির্মম সত্যে। বড় আফসোস হয়, এমন সন্তান কেন মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল, যে একটি নিরপরাধ প্রাণীর প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারে! তার হাত কি একটুও কাঁপেনি এই জঘন্য কাজ করার সময়?

আজ এক অদ্ভুত বেদনাবিধুর দৃশ্য! মনু মিয়া হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আর তাঁর সেই প্রাণপ্রিয়, যে ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী, সেই অভাগা ঘোড়াটি? সে আজ শায়িত মাটির গভীরে, এক অজানা কবরে। যে ঘোড়াটি এতদিন অন্যকে কবরে পৌঁছে দিয়েছে, আজ সে নিজেই চিরনিদ্রায় শায়িত। যে মনু মিয়া অসংখ্য মানুষের কবর খুঁড়েছেন, আজ তাঁর সবচেয়ে আপনজনদের একজনকেই শুইয়ে দেওয়া হলো তাঁর খোঁড়া কবরের আদলে গড়া অন্য এক কবরে, যা তিনি নিজ হাতে খুঁড়তে পারেননি।

এ কেমন বিচার? এ কেমন নিয়তি? যে মানুষটি নিজের জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় অন্যের শেষ বিদায়ের ব্যবস্থাপনায় কাটিয়ে দিলেন, আজ তাঁরই বিদায়বেলা যেন আরও করুণ, আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছে তাঁর প্রিয় সঙ্গীর অকাল প্রয়াণে। হাসপাতালের নির্জন কক্ষে শুয়ে মনু মিয়া যখন জানবেন তাঁর ঘোড়াটির এই মর্মান্তিক পরিণতির কথা, তখন তাঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি আমরা অনুভব করতে পারব? তাঁর প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে থাকবে না পাওয়ার যন্ত্রণা আর গভীর ভালোবাসা।

মনু মিয়া আর তাঁর ঘোড়ার এই গল্প শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ গল্প যেন আমাদের সমাজের এক গভীর ক্ষতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একদিকে যেমন মনু মিয়ার মতো নিঃস্বার্থ মানুষের উদাহরণ আমাদের অনুপ্রাণিত করে, অন্যদিকে তেমন অমানুষিক নির্মমতা আমাদের লজ্জিত করে, আতঙ্কিত করে। এই পৃথিবীতে ভালোবাসার যেমন অভাব নেই, তেমনি নিষ্ঠুরতারও যেন শেষ নেই।

মনু মিয়ার আরোগ্য কামনা করি। কিন্তু তাঁর মনের যে ক্ষত, তা কি কোনোদিন শুকোবে? তাঁর জীবনের বাকি কটা দিন হয়তো এই অব্যক্ত বেদনা নিয়েই তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। আর সেই অভাগা ঘোড়াটি? সে তো চলেই গেল, রেখে গেল একরাশ প্রশ্ন আর সীমাহীন শূন্যতা। তার নীরব চোখের চাহনি, তার মনিবের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য – এসবই আজ কেবলই স্মৃতি।

কিশোরগঞ্জের মাটি যেমন গুণীজনদের জন্ম দিয়ে ধন্য, তেমনই মনু মিয়ার মতো সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনগাথাও এই মাটিকে করেছে মহিমান্বিত। কিন্তু তাঁর প্রিয় সঙ্গীর এমন মর্মান্তিক পরিণতি এই মহিমার গায়ে এক কলঙ্কের দাগ এঁকে দিল। এই কলঙ্ক শুধু হত্যাকারীর নয়, এই কলঙ্ক হয়তো আমাদের সবার, যারা একটি প্রাণীর প্রতি ন্যূনতম সংবেদনশীলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। মনু মিয়া আর তাঁর ঘোড়ার এই উপাখ্যান যুগ যুগ ধরে আমাদের বিবেককে দংশন করতে থাকুক, আমাদের মনে করিয়ে দিক – ভালোবাসাই পরম ধর্ম, আর নিষ্ঠুরতা মহাপাপ।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।