বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

রেমিট্যান্সে মার্কিন করের খড়গ, প্রবাসীদের দুশ্চিন্তা, প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২০ মে ২০২৫ | ২:২০ অপরাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই এবার দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই উদ্যোগটি ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামে হাউজ বাজেট কমিটিতে অনুমোদন পেয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে এবং এর ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট কমিটিতে পাস হওয়া এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মার্কিন নাগরিক নন এমন সব অভিবাসী, এমনকি গ্রিনকার্ডধারী বা এইচ-১বি ভিসাধারীরাও রেমিট্যান্স পাঠানোর সময় এই ৫ শতাংশ করের আওতায় আসবেন। আইনে ন্যূনতম কোনো ছাড়ের সীমা রাখা হয়নি, অর্থাৎ অল্প অঙ্কের টাকা পাঠালেও এই কর প্রযোজ্য হবে। ১ হাজার ১১৬ পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধুমাত্র ‘যাচাইকৃত মার্কিন প্রেরক’ অর্থাৎ যারা মার্কিন নাগরিক, তাদের পাঠানো অর্থে এই কর বসবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের অন্যতম প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৯৪ কোটি ৫ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৮ হাজার ৭৪ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ কর কার্যকর হলে এই সময়ের রেমিট্যান্সের ওপর প্রায় ১৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ২ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা কর হিসেবে কেটে রাখা হতো।

গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৫২ কোটি ২২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশটি থেকে।

তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রকৃত উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থের একটি বড় অংশ মার্কিন বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার ও অ্যাগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসায় তা যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব থেকে দেখানো হয়। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সম্প্রতি মাস্টারকার্ড, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও ইনস্ট্যান্ট ক্যাশের মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রেমিট্যান্স বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি উঠে আসে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখন প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসছে। এর ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপ হলে মাসে দেড় থেকে দুই কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যাবে। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ।”

তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের কত শতাংশ সে দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পাঠানো, তা নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত অ্যাগ্রিগেটরদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে সমঝোতায় আসা এবং রেমিট্যান্সের উৎস দেশের পরিসংখ্যান ঠিক করা।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নতুন কর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় পাঁচ কোটি অভিবাসীকে প্রভাবিত করবে, যারা এরই মধ্যে নিয়মিত কর প্রদান করেন। মাইগ্রেশন ও রেমিট্যান্স বিষয়ক বিশ্লেষক এবং ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগের গবেষক ম্যানুয়েল ওরোজকো বলেছেন, “এই কর আরোপের ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ব্যক্তিগত খরচে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এবং এটি অভিবাসীদের জন্য আর্থিক চাপ তৈরি করবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এর ফলে অনানুষ্ঠানিক পথে অর্থ প্রেরণের প্রবণতা বাড়তে পারে, যা গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছিল।”

এর আগে গত ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করে। পরে ৯ এপ্রিল চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের জন্য এই শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার কথা জানান তিনি।