
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে কনটেইনার রাখার খরচ বা স্টোর রেন্ট একলাফে চারগুণ বৃদ্ধি করায় রপ্তানি বাণিজ্যে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, বন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা না বাড়িয়ে এবং কাস্টমস জটিলতা নিরসন না করে কেবল ডেমারেজ বা জরিমানা আরোপের মাধ্যমে কনটেইনার ডেলিভারি বাড়ানো সম্ভব নয়। উল্টো এই ধরনের পদক্ষেপে বিশ্ববাজারে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক কার্যকারিতা ও সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ড ও ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে কনটেইনারের ধীরগতির খালাস প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে কন্টেইনার পড়ে থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে উল্লেখ করে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়, ২১ দিন বা তার বেশি সময় ধরে বন্দরে অবস্থানরত কনটেইনারের জন্য ৯ মার্চ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয় এবং ১০ মার্চ থেকে চারগুণ স্টোর রেন্ট বা জরিমানা আদায়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। তারা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। গত ৫ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিএমসিসিআই) এবং ১৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যাসোসিয়েশন পৃথক পৃথক চিঠিতে নৌপরিবহন উপদেষ্টার কাছে চারগুণ স্টোর রেন্ট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের জোর দাবি জানায়। চিঠিতে তারা আরও উল্লেখ করে, কনটেইনার দ্রুত খালাসে বিলম্বের জন্য ব্যবসায়ীরা এককভাবে দায়ী নন, বরং কাস্টমসের বিভিন্ন পদ্ধতিগত জটিলতাই এর প্রধান কারণ। এছাড়া, বিগত কয়েক দিনে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলম বিরতির কারণে বন্দরে কনটেইনার জট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলেও তারা মনে করেন।
পরিসংখ্যান বলছে, জরিমানা আরোপের পরও বন্দরে কনটেইনার জট কমেনি, বরং তা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিজিএমইএ’র পোর্ট ও শিপিং বিষয়ক উপদেষ্টা এবং মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ-সভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী জানান, বন্দর কর্তৃপক্ষের সার্কুলার জারির সময় (২০ ফেব্রুয়ারি) বন্দরে কনটেইনারের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ২২০ টিইইউস (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)। কিন্তু জরিমানা কার্যকরের পর ৩ মে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৭৫৭ টিইইউসে এবং ৭ মে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ হাজার ২৩১ টিইইউসে পৌঁছায়। তিনি অভিযোগ করেন, “বন্দরের সক্ষমতা না বাড়িয়ে এবং বিজিএমইএর মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করেই এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক উভয়ই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।” তিনি বন্দরের অব্যবহৃত জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে নতুন ইয়ার্ড ও শেড নির্মাণের তাগিদ দেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক চিঠিতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলা হয়, পর্যাপ্ত শেড সংকটের কারণে সম্প্রতি একটি এলসিএল (লেস দ্যান কনটেইনার লোড) পণ্য খালাস করতে ১৮ দিন সময় লেগেছে। অন্য একটি ঘটনায়, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ একটি পণ্যের চালান ৯৮ দিনের জন্য লক করে রাখে। এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণে শুধু বন্দরের চার্জই দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, যা আমদানি করা পণ্যের মূল্যের প্রায় সমান। বন্দর ও শিপিং ডেমারেজসহ পণ্যের মূল্যের কাছাকাছি জরিমানা আসায় বহু ব্যবসায়ী লোকসানের ভয়ে পণ্য খালাস নিতে পারছেন না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামিল আহমেদ বলেন, “কাস্টমসের ছাড়পত্র এবং প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়া কোনোভাবেই পণ্য খালাস করা সম্ভব নয়। তাই কন্টেইনার খালাসে বিলম্বের সম্পূর্ণ দায় আমদানিকারকের ওপর চাপানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায্য। এই বর্ধিত স্টোর রেন্টের কারণে উৎপাদন খরচ বহুগুণে বেড়ে যাবে এবং ফলস্বরূপ বাজারে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাবে।” তিনি অবিলম্বে স্টোর রেন্ট বৃদ্ধির এই অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান।
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন, শেড নির্মাণ এবং কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমেই কেবল কনটেইনার জট কমানো সম্ভব। অন্যথায়, শুধুমাত্র জরিমানা আরোপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং তা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে আরও সংকটের মুখে ঠেলে দেবে।