
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট প্রস্তাব করেছে। এই বাজেটে উন্নয়ন খাতে কিছু পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বিশেষ করে, কিছু মেগা প্রকল্প থেকে সরে আসার ইঙ্গিত প্রশংসনীয়। তবে, জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত – শিক্ষা ও স্বাস্থ্য – এক্ষেত্রে যেন কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই দুই খাতে চলতি বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমার প্রস্তাবনা উত্থাপিত হয়েছে। এটি জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিগত প্রায় সাড়ে পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকার বহু অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এসব প্রকল্পের কারণে জনগণের উপর ঋণের এক বিশাল বোঝা চেপেছে। সেই কঠিন বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সঠিক। এমন পদক্ষেপ দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। জনগণের অর্থ সাশ্রয় হবে। তবে, এই সাশ্রয়ের অভিঘাত যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতে পড়ে, তবে তা চূড়ান্ত বিচারে জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত খসড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আমাদের চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে। তথ্য বলছে, আগামী অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। এই অঙ্কটি চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি বরাদ্দ থেকে প্রায় ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। আমরা জানি, চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। শিক্ষা হলো একটি জাতির মেরুদণ্ড। এই খাতে বরাদ্দ কমানো হলে আমরা কীভাবে একটি দক্ষ, যোগ্য ও আলোকিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারি? আমাদের সন্তানেরা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে কী করে? এই প্রশ্নগুলো আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
একইভাবে, স্বাস্থ্য খাতের চিত্রও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দ কমছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। একটি সুস্থ ও সবল জাতি ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, সহজলভ্যতা এবং চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ অপরিহার্য। এই খাতে বরাদ্দ কমানো হলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা প্রাপ্তি আরও কঠিন হয়ে পড়বে। জনস্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
নতুন খসড়া এডিপি পর্যালোচনা করলে বরাদ্দের একটি গতানুগতিক চিত্র ফুটে ওঠে। সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, যার পরিমাণ ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ, ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য। এই খাতও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা খাত, যা পাচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। বরাদ্দের এই যে বিন্যাস, তা যেন বহু বছরের প্রথাগত ঐতিহ্যেরই এক ধরনের প্রতিফলন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি, কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নকে উপেক্ষা করে সেই উন্নয়ন কতটা টেকসই হবে, তা ভেবে দেখা দরকার।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, যাঁরা এখন দেশের নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা বিগত দিনগুলোতে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব খাতের কাঠামোগত সংস্কারের উপর তাঁরা নিয়মিত গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাঁদের আলোচনা, বক্তৃতা ও লেখনিতে এসব বিষয় প্রাধান্য পেত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে তাঁদের সেই ইতিবাচক চিন্তাভাবনার কোনো সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এর অর্থ দাঁড়ায়, একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারাও যেন পুরোনো, গতানুগতিক পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে এই বাস্তবতার একটি বড় ফারাক তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যদি আমরা আমাদের অবস্থান বিচার করি, তাহলে চিত্রটা আরও বেশি হতাশাজনক। বিশ্বব্যাংকের তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পৃথিবীর যে দশটি দেশ তাদের অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করে, বাংলাদেশ সেই তালিকায় অন্যতম। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি পরিসংখ্যান। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পেতে হলে একজন বাংলাদেশির বছরে ন্যূনতম ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু বার্ষিক খরচ হয় মাত্র ৫৮ ডলার। এই খরচের একটি বড় অংশ আবার নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। ফলে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাজেট শুধু কিছু সংখ্যার আর্থিক হিসাব-নিকাশ নয়। এটি একটি সরকারের অর্থনৈতিক দর্শন এবং তার জনকল্যাণমূলক মানসিকতারও প্রতিচ্ছবি। অতীতে ক্ষমতায় থাকা প্রায় সব সরকারের বিরুদ্ধেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করার অভিযোগ ছিল। বিগত সরকারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেটকে মূলত এই দুই খাতের অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের বাজেটে পরিণত করেছিল। অর্থাৎ, নতুন স্কুলভবন নির্মাণ, হাসপাতাল তৈরি বা যন্ত্রপাতি কেনাকাটার মধ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণায় উৎসাহ দান, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, চিকিৎসক-নার্সদের পর্যাপ্ত সুবিধা প্রদান ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার সেই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার দৃশ্যমান কোনো চেষ্টা করেছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনো আমরা পাইনি।
সরকার গঠিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যেখানে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করেছিল, সেখানে সরকার এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে পারেনি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা না-ই বা করলাম, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দের হার সর্বনিম্ন। এত কম বরাদ্দ দিয়ে কীভাবে আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষা ও বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা আশা করতে পারি?
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ হলো ভবিষ্যতের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। এর সুফল তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে একটি শিক্ষিত ও সুস্থ জাতি দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আমরা আশা করতে চাই, সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকগণ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পুনর্বিবেচনা করবেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কেবল বৃদ্ধিই নয়, বরং এর সঠিক ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এই দুটি খাতে কোনো ধরনের অবহেলা কাম্য নয়। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমাদের কামনা।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।