বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

জলদস্যু বৃক্ষের পতন, মাটির বুকে ফিরুক প্রাণের স্পন্দন

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২৩ মে ২০২৫ | ১২:২২ অপরাহ্ন

বহু বছর ধরে পরিবেশবিদ আর সচেতন মানুষেরা একটি আশঙ্কার কথা সোচ্চার কণ্ঠে বলে আসছিলেন। সেই আশঙ্কা ছিল আমাদের প্রকৃতিতে আগ্রাসী বিদেশি গাছের বিস্তার নিয়ে, বিশেষ করে ইউক্যালিপটাস আর আকাশমণি নামের দুটি গাছকে ঘিরে। তাঁরা বারবার সতর্ক করেছেন, এই গাছগুলো আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ যে তাঁদের এই উদ্বেগের সাথে একমত ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু সেই মৌখিক সহমর্মিতা কখনো কঠিন পদক্ষেপে রূপান্তরিত হয়নি। অনেকটা ‘দেখছি দেখব’ বা ‘করছি করব’ মানসিকতায় মূল্যবান সময় পেরিয়ে গেছে।

তবে দেরিতে হলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সব ধরনের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চারা তৈরি, রোপণ এবং বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৫ মে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

এই প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার স্বার্থে, এবং একইসাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে এই দুটি গাছের চারা উৎপাদন, রোপণ ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হলো। এই সিদ্ধান্তকে আমরা শুধু স্বাগত জানাই না, বরং একে পরিবেশ সুরক্ষার পথে একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখি।

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি – এই দুটি গাছের প্রভাব আমাদের প্রকৃতিতে খুবই গভীর এবং বহুমাত্রিক। সাধারণ মানুষের কাছে এই গাছগুলো দ্রুত বর্ধনশীল এবং সবুজের সমাহার মনে হলেও, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে এর নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরছেন। ইউক্যালিপটাস গাছটি যেন মাটির গভীর থেকে এক দানবের মতো পানি শুষে নেয়। এর ফলস্বরূপ, আশেপাশের মাটির জলস্তর নিচে নেমে যায়, মাটি শুষ্ক ও অনুর্বর হয়ে পড়ে। এটি কেবল কৃষিকাজের জন্যই বিরাট হুমকি নয়, বরং আশেপাশের অন্যান্য দেশীয় উদ্ভিদের জন্যও জীবনধারণ কঠিন করে তোলে।

এখানেই শেষ নয়, ইউক্যালিপটাস গাছের মূল এবং পাতা থেকে এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো মাটিতে মিশে অন্যান্য গাছের বৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলে। ফলে, যে জমিতে ইউক্যালিপটাস থাকে, সেখানে অন্য কোনো গাছ সহজে বাড়তে চায় না, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি অশনিসংকেত।

অন্যদিকে, আকাশমণি গাছটিও কম ক্ষতিকর নয়। এটি খুব দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল আকার ধারণ করে। এর ফলে, আশপাশের অন্যান্য দেশীয় গাছপালা প্রয়োজনীয় স্থান, আলো এবং মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহে পিছিয়ে পড়ে। আকাশমণি একাই যেন সবটুকু আলো-বাতাস-পুষ্টি নিজের দখলে নিয়ে নেয়, যার পরিণতিতে আমাদের নিজস্ব প্রজাতির গাছগুলো ঠিকমতো বিকশিত হতে পারে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আমাদের দেশের পাখি, পোকামাকড় কিংবা ছোট ছোট প্রাণীরা এই আকাশমণি গাছে বাসা তৈরি করে না বা আশ্রয় নেয় না। এর কারণ হলো, এই গাছগুলো আমাদের স্থানীয় প্রাণিকুলের সঙ্গে সমন্বয়পূর্ণ নয়। উপরন্তু, আকাশমণি গাছের ফুলের রেণু বাতাসে মিশে মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টের মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি করতে পারে। এটি জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি উদ্বেগের বিষয়। সুতরাং, এই গাছগুলো আপাতদৃষ্টিতে সবুজ মনে হলেও, এরা আসলে নীরবে আমাদের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে।

একসময় আমাদের এই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষরাজির এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি উজাড় এবং বিশেষ করে আগ্রাসী বিদেশি প্রজাতির গাছের প্রভাবে সেই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় আমাদের দেশে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৩ হাজার ৮৩২টি পর্যন্ত নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যে তথ্য দিয়েছেন, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি বলেছেন, বিদেশি এই আগ্রাসী গাছ ও গুল্মের ক্রমাগত বিস্তারের ফলে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে অন্তত এক হাজার দেশীয় প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

ভাবা যায়, এক হাজার প্রজাতির গাছ আমরা হারিয়ে ফেলেছি! এই ক্ষতি শুধু গাছের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, অণুজীব – সবকিছু নিয়ে যে একটি সমন্বিত ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র আমাদের ছিল, সেটি আজ মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে। প্রতিটি দেশীয় গাছ শুধু একটি গাছ নয়, সেটি অসংখ্য প্রাণী ও অণুজীবের আবাসস্থল এবং খাদ্যভাণ্ডার। যখন একটি দেশীয় প্রজাতি হারিয়ে যায়, তখন তার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক প্রাণী ও অণুজীবও অস্তিত্বের সংকটে পড়ে।

তবে, আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও সরকার ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির মতো ক্ষতিকর বিদেশি গাছ লাগানো ও বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পরিবেশের সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। এটি একটি ভালো সূচনা, কিন্তু আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশীয় প্রজাতির গাছের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং মনোযোগ ফিরিয়ে আনা। আমাদের বনজ, ঔষধি, ফলজ ও ফুলজ গাছ, যেমন – আম, জাম, কাঁঠাল, বকুল, শিমুল, পলাশ, অর্জুন, বহেরা, হরীতকী, নিম, শাল, সেগুনসহ অসংখ্য উপকারী দেশীয় গাছ লাগানোর জন্য একটি সমন্বিত ও ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই গাছগুলো আমাদের পরিবেশের সঙ্গে হাজার বছর ধরে অভিযোজিত। এরা আমাদের মাটির উর্বরতা বাড়ায়, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এরা আমাদের স্থানীয় পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের খাদ্য ও বাসস্থানের জোগান দেয়।

প্রতিবছর অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ বা বৃক্ষরোপণ পক্ষ পালন করা হয়। এ সময় স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত এবং বাড়ির আশেপাশে লক্ষ লক্ষ চারা রোপণ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই রোপণ করা চারার একটি বড় অংশই পরবর্তীকালে সঠিক পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মারা যায়। এটি একটি বিরাট অপচয়। শুধু চারা রোপণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং সেই চারাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ গাছে রূপান্তরিত করার জন্য নিয়মিত পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, যেমন বন বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় তদারকির প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষকেও এই বিষয়ে আরও বেশি সচেতন এবং সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে, দেশের নার্সারিগুলো যাতে কোনোভাবেই এই নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকর বিদেশি গাছের চারা তৈরি বা বিক্রি করতে না পারে, সেদিকে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে হবে এবং নিয়ম ভঙ্গকারী নার্সারিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির মতো পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ গাছগুলোর রোপণ ও বিপণন বহু আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। সেই সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু ‘বিলম্বিত হলেও ভালো’ – এই প্রবাদটিকে সামনে রেখে সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আশা করা যায়, এই সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি ইতিবাচক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করবে।

তবে, এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি গাছ রোপণ ও বিপণন নিষিদ্ধ করার অর্থ এই নয় যে, বর্তমানে আমাদের চারপাশে যত এই ধরনের গাছ রয়েছে, সেগুলোকে এখনই কেটে ফেলতে হবে। হুট করে দেশের উদ্যান, রাস্তার ধার বা অন্যান্য স্থানে থাকা লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেললে তা পরিবেশের উপর আরেকটি নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এতে হঠাৎ করে সবুজ আচ্ছাদন কমে যাবে, যা কাম্য নয়। বরং, আমাদের একটি পরিকল্পিত ও পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথমত, দেশীয় জাতের বিভিন্ন উপকারী গাছের চারা ব্যাপকভাবে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যখন এই নতুন লাগানো দেশীয় গাছগুলো কিছুটা বড় হয়ে উঠবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে শুরু করবে, তখন ধীরে ধীরে ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছগুলো অপসারণ করা যেতে পারে। এতে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না এবং সবুজ আচ্ছাদনও বজায় থাকবে।

পরিশেষে বলা যায়, এই সিদ্ধান্তটি একটি সূচনা মাত্র। একে সফল করতে হলে প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা, পরিবেশবিদদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশ রেখে যেতে হলে দেশীয় বৃক্ষরোপণকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের আন্তরিক প্রচেষ্টাই গড়ে তুলতে পারে সবুজে ভরা এক নতুন বাংলাদেশ।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।