বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বাংলাদেশের এসএমই: সম্ভাবনার দিগন্ত প্রসারিত, তবু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অধরা কেন?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২৫ মে ২০২৫ | ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্যানভাসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খাতটি একটি নীরব বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে এই খাতের যে অমিত সম্ভাবনা, তা আজ সর্বজনস্বীকৃত। শ্রমঘন এই শিল্পকাঠামোটি, বিশেষত যেখানে প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই উপযুক্ত কর্মের অভাবে দিশেহারা, সেখানে আশার আলো দেখাতে পারত। কিন্তু সব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও, এই খাত থেকে আমরা যে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যটুকু আশা করেছিলাম, তা যেন মরীচিকার মতোই অধরা রয়ে গেছে। বাস্তবতার কঠিন জমিনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, এই অপার সম্ভাবনাকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না?

উদ্যোক্তাদের অদম্য স্পৃহা প্রশংসনীয়। তারা তাদের অর্জিত লাভের প্রায় ৩০ শতাংশ এই খাতেই পুনঃবিনিয়োগ করছেন, যা তাদের অঙ্গীকার ও আস্থার পরিচায়ক। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এসএমই খাতের প্রসারে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উৎসাহিত করছে, প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা ও কারিগরি জ্ঞান প্রদানেও তারা আগ্রহী। এতকিছুর পরেও, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপিতে) এসএমই খাতের অবদান দেখলে হতাশ হতে হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অবদান ছিল মাত্র ৭.৩৫ শতাংশ। অথচ, আমাদের প্রতিবেশী ও তুলনীয় অর্থনীতির দেশগুলোর দিকে তাকালে এই চিত্র আরও বেশি পীড়াদায়ক মনে হয়। পাকিস্তানে এসএমই খাতের অবদান ৪০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৫২ শতাংশ, চীনে ৬০ শতাংশ এবং ভারতে ৩৭ শতাংশ। এই তুলনামূলক পরিসংখ্যান কেবল আমাদের দুর্বলতাকেই প্রকট করে তোলে না, বরং এটি একটি গভীর আত্মজিজ্ঞাসারও জন্ম দেয় – সম্ভাবনার এমন উর্বর ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন এতটা পিছিয়ে? এই ৭.৩৫ শতাংশের পরিসংখ্যানটি আসলে একটি সতর্কবার্তা; এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এসএমই খাতের প্রকৃত শক্তিকে কাজে লাগাতে আমাদের নীতিগত, কাঠামোগত এবং প্রয়োগিক পর্যায়ে আরও বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে। এটি নিছক একটি সংখ্যা নয়, এটি লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তার স্বপ্নভঙ্গ এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার প্রতিচ্ছবি।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত পশ্চাৎপদতার কারণ অনুসন্ধানে গেলে উদ্যোক্তাদের জবানিতে বেশ কিছু মৌলিক প্রতিবন্ধকতার কথা শোনা যায়, যা দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এই বাধাগুলো সম্মিলিতভাবে একটি জটিল জাল তৈরি করেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এক কঠিন সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।

প্রথম এবং প্রধান অন্তরায় হলো অর্থায়নের প্রকট সংকট। নতুন উদ্যোগ শুরু করা কিংবা বিদ্যমান ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করার জন্য যে পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন, তার জোগান পাওয়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য প্রায়শই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ, জটিল প্রক্রিয়া, জামানতের কড়াকড়ি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চ সুদের হার এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। ফলে, অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায় অথবা সীমিত পরিসরে আটকে থাকে।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তির অপ্রতুল ব্যবহার। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার এই যুগে টিকে থাকতে হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই, যার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির অঙ্গীভূতকরণ অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠান এখনো সনাতন পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। প্রয়োজনীয় জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সক্ষমতার অভাবে তারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে পিছিয়ে পড়ছে, যা তাদের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।

তৃতীয়ত, দুর্বল ও অপ্রতুল অবকাঠামো। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক যেকোনো ব্যবসার প্রসারের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এই খাতগুলোতে আমাদের ঘাটতি ব্যাপক। অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, অনুন্নত রাস্তাঘাট ও পরিবহন ব্যবস্থা পণ্যের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং ধীরগতির ইন্টারনেট ডিজিটাল যুগে ব্যবসার সুযোগকে সীমিত করে ফেলে। এই সম্মিলিত অবকাঠামোগত দুর্বলতা ব্যবসার পরিচালন ব্যয়কে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়িয়ে দেয়।

চতুর্থত, বাজারে অসম ও তীব্র প্রতিযোগিতা। একদিকে যেমন বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অসম প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কঠিন, অন্যদিকে অসাধু সিন্ডিকেট এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতাও তাদের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে। বাজারের নিয়মনীতি অনেক সময় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিকূলে থাকে, যা তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে।

পঞ্চমত, ব্যবস্থাপনা দক্ষতার অভাব। একটি ব্যবসাকে সফলভাবে পরিচালনা ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আধুনিক ব্যবস্থাপনা কৌশল, আর্থিক পরিকল্পনা, বিপণন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জ্ঞান অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার মধ্যেই এই দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা তাদের গৃহীত পদক্ষেপের কার্যকারিতাকে সীমিত করে ফেলে।

এই মৌলিক বাধাগুলোর পাশাপাশি স্থান ও কালভেদে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো রয়েছেই। এই সমন্বিত প্রতিকূলতা উদ্যোক্তাদের মনোবল ভেঙে দেয় এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশকে বিনিয়োগের জন্য অস্বাভাবিক করে তোলে।

এই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে এবং এসএমই খাতকে তার প্রকৃত সম্ভাবনায় বিকশিত করতে হলে গতানুগতিক চিন্তাভাবনা ও পদক্ষেপের বাইরে গিয়ে কিছু কার্যকর ও সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে একাধিক সুপারিশ প্রদান করেছেন, যা নীতি নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারে।

প্রথমত, অর্থায়নের দুয়ার উন্মোচন করতে হবে। সহজ শর্তে, ন্যূনতম সুদে এবং ক্ষেত্রবিশেষে জামানতবিহীন ঋণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এসএমই খাতের জন্য বিশেষায়িত তহবিল গঠন, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম এবং প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো এই খাতের রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক করতে পারে। ব্যাংকগুলোকে তাদের চিরাচরিত ঝুঁকি বিমুখ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে এসএমই অর্থায়নে আরও সক্রিয় ও উদ্ভাবনী ভূমিকা পালন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। নিয়মিতভাবে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন, আধুনিক ব্যবসায়িক কলাকৌশল সম্পর্কে ধারণা প্রদান এবং সাশ্রয়ী মূল্যে বা সহজ শর্তে আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর এই খাতের গুণগত পরিবর্তনে সহায়ক হবে। কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উপর আরও বেশি জোর দিতে হবে।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ক্রমবর্ধমান ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে এসএমই খাতের পণ্য ও সেবার ব্যাপকভিত্তিক সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এটি তাদের বাজারের পরিধি ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে বহুগুণে বিস্তৃত করতে পারে। ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম এবং লজিস্টিক সাপোর্টের বিষয়ে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান জরুরি।

চতুর্থত, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জটিল ও সময়সাপেক্ষ কর কাঠামো, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সরলীকরণ করতে হবে। ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বা এ ধরনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা প্রণয়ন করে উদ্যোক্তাদের হয়রানি কমাতে হবে।

পঞ্চমত, বাজার সংযোগ ও ব্র্যান্ডিংয়ে সহায়তা করতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এসএমই পণ্যের পরিচিতি ও প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে বাণিজ্য মেলা, পণ্যের প্রদর্শনী এবং ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলনের আয়োজন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাদের পণ্যের বিপণন, নেটওয়ার্কিং এবং ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির সুযোগ পাবেন।

এসএমই ফাউন্ডেশন এই খাতের উন্নয়নে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে তাদের ১৪০টি প্রস্তাবনা পেশ করা এবং এসএমইবান্ধব ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, গবেষণা, পলিসি অ্যাডভোকেসি, ক্লাস্টার উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, আইসিটি সহায়তা, দক্ষতা ও নারী-উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং সহজ শর্তে অর্থায়নের মতো বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা তাদের সদিচ্ছারই প্রতিফলন। তবে, এই সকল প্রস্তাবনা ও কার্যক্রমের প্রকৃত সুফল নির্ভর করছে সেগুলোর দ্রুত ও কার্যকর বাস্তবায়নের উপর। কাগজে-কলমে গৃহীত পদক্ষেপ এবং মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার মধ্যে যে ফারাক, তা দূর করতে না পারলে এই প্রচেষ্টাগুলোও কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। প্রয়োজন দৃশ্যমান অগ্রগতি, যা উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন করে আস্থা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করবে।

পরিশেষে, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এসএমই খাতকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা এবং দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। জিডিপিতে এই খাতের অবদানকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি সামগ্রিক, সমন্বিত এবং টেকসই জাতীয় কৌশল। শুধু সদিচ্ছা বা মৌখিক প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন নীতিগত ধারাবাহিকতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মাঠ পর্যায়ে তার যথাযথ প্রয়োগ।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক এবং সর্বোপরি উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ও সম্মিলিত প্রয়াসে সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এসএমই খাতকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব। এই সম্ভাবনার মশালকে প্রজ্বলিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এর মাধ্যমেই আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং একটি সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।