
সম্প্রতি এক ইউটিউবারের করা একটি মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি নাকি বলেছেন, “গ্রামের মানুষ টক্সিক!” এই একটি বাক্য যেন শহুরে সভ্যতার আলোয় বেড়ে ওঠা অনেকের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক ধরনের উন্নাসিকতাকেই প্রকাশ করে। কিন্তু আসলেই কি তাই? বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যার আত্মা এখনো গ্রামে প্রোথিত, সেখানকার মানুষদের ঢালাওভাবে ‘টক্সিক’ বা বিষাক্ত বলে দেওয়াটা কি কেবল অজ্ঞতা, নাকি এক ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্য? আজকে আমরা সেই বিষয়টিই খতিয়ে দেখব।
প্রথমেই বুঝতে হবে, বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের মূল ভিত্তিই হলো গ্রাম। দেশের সিংহভাগ মানুষ, প্রায় সত্তর শতাংশের কাছাকাছি, এখনো গ্রামে বসবাস করেন। এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশো ষাট বর্গকিলোমিটারের এই দেশে বিভাগীয় বা জেলা শহরের সংখ্যা হাতেগোনা, কিন্তু গ্রামের সংখ্যা প্রায় সাতাশি হাজারেরও বেশি। এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীই এদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাদের জীবনযাত্রা হয়তো শহরের মতো চাকচিক্যময় নয়, তবে সেখানে রয়েছে এক অনাবিল সারল্য, যা আজকাল শহুরে জীবনে খুঁজে পাওয়া ভার।
গ্রামের মানুষের জীবনপ্রবাহ শহরের যান্ত্রিকতা থেকে বহু দূরে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে পাখির কিচিরমিচির শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, স্বচ্ছ পানির পুকুর আর তাতে খেলা করা মাছ – এই হলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এখনো যৌথ পরিবার, যেখানে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, বাবা-মা আর ভাইবোনেরা একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করে। এই যৌথতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক শক্তিশালী ভিত্তি। শিশুরা বেড়ে ওঠে এক বৃহত্তর পারিবারিক আবহে, যেখানে তারা শুধু বাবা-মায়ের আদরই নয়, বরং পরিবারের অন্য সদস্যদের স্নেহ-ভালোবাসাও পায়। একটা খালি জায়গা দেখলেই গ্রামের ছেলেদের মন কৌতূহলে ভরে ওঠে, তারা মেতে ওঠে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা বা হা-ডু-ডু’র মতো সব গ্রামীণ খেলাধুলায়। এই নির্মল আনন্দ কি শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি শিশুরা কল্পনা করতে পারে?
গ্রামের মানুষগুলো কঠোর পরিশ্রমী। কৃষক সারাদিন মাঠে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সোনার ফসল ফলায়। সেই ফসলে কেবল তার নিজের পরিবারেরই নয়, শহরের কোটি কোটি মানুষের অন্নের সংস্থান হয়। জেলেরা রাতের আঁধারে নদীতে বা সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরে, সেই মাছ শহরের বাজারে পৌঁছে যায়। গ্রামের মা-বোনেরা শুধু রান্নাবান্না আর ঘরকন্নাতেই সীমাবদ্ধ নন, তারা কৃষিকাজেও পুরুষের সমান তালে সহযোগিতা করেন। ধান ভানা, মুড়ি ভাজা, কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে গবাদিপশু পালন – সবকিছুতেই তাদের হাতের ছোঁয়া। এই যে সম্মিলিত শ্রম, এটাই গ্রামের শক্তি। এই মানুষগুলো যদি তাদের কাজ থামিয়ে দেয়, তাহলে শহরের অট্টালিকাগুলো পরিণত হবে অভুক্ত মানুষের কারাগারে।
এবার আসা যাক ‘টক্সিক’ বা ঝগড়াটে আচরণের প্রসঙ্গে। এটা কি কেবল গ্রামের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? শহরে কি দলাদলি, রেষারেষি, পরশ্রীকাতরতা বা স্বার্থপরতা নেই? বরং অনেক ক্ষেত্রেই শহরের মানুষের আচরণ আরও বেশি জটিল ও হিসেবি। গ্রামে হয়তো তুচ্ছ কারণে ঝগড়াঝাঁটি হয়, জমিজমা নিয়ে বিরোধ লাগে, কিন্তু সেই বিরোধ মীমাংসার জন্য গ্রামের মোড়ল বা বয়োজ্যেষ্ঠরা এগিয়ে আসেন। সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান গ্রামেই হয়ে যায়। কিন্তু শহরে? সামান্য কথাকাটাকাটি হলেই মানুষ থানায় ছোটে, উকিলের দ্বারস্থ হয়। সম্পর্কের বাঁধন সেখানে অনেক বেশি ঠুনকো। গ্রামের মানুষ হয়তো সাময়িক মনোমালিন্য করে, কিন্তু ঈদের দিনে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা ঠিকই একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশল বিনিময় করে, পুরনো তিক্ততা ভুলে যায়।
গ্রামের শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ শহরের শিশুদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও আনন্দময়। কবি জসীমউদ্দীনের কবিতার পঙক্তিগুলো যেন গ্রামের শিশুদের জন্যই লেখা: “আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামা বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে, আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের শাখায় উঠে রঙিন করি মুখ।” গ্রামের শিশুরা প্রকৃতির কোলে অবাধে ঘুরে বেড়ায়, গাছে চড়ে আম-জাম পেড়ে খায়, পুকুরে সাঁতার কাটে। তাদের ঠোঁট পাকা জামের রসে রঙিন হয়, মনে থাকে না কোনো বিষণ্ণতা। গ্রামেও অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আছে, যারা শহরে চাকরি করতে যায়। কিন্তু তাদের আদরের সন্তানগুলো দাদা-দাদি বা চাচা-চাচির কাছে নিশ্চিন্তে রেখে যেতে পারে। এই পারিবারিক বন্ধন ও আস্থা গ্রামের এক অমূল্য সম্পদ।
বিপদ-আপদে গ্রামের মানুষ যেভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়, তার তুলনা মেলা ভার। কারো বাড়িতে আগুন লাগলে গ্রামের সবাই মিলে বালতি হাতে ছুটে আসে আগুন নেভাতে। কেউ অসুস্থ হলে পাড়া-প্রতিবেশীরাই তার সেবা-শুশ্রূষার দায়িত্ব নেয়, হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। কোনো দরিদ্র মেয়ের বিয়েতে গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে সাহায্য করে। এমনকি কোনো মানুষ মারা গেলে তার সৎকার বা দাফন-কাফনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রামের মানুষ সম্মিলিতভাবে পালন করে। শহরে পাশের ফ্ল্যাটে কে অসুস্থ হয়ে মারা গেল, সেই খবরও অনেকে রাখে না। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা তো দূরের কথা, অনেকে পারলে সেই ঘটনার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেই বেশি ব্যস্ত থাকে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নব্বইয়ের দশকের আগের গ্রামের মানুষজন তথ্যপ্রযুক্তি বা আধুনিক শহুরে জীবনযাত্রা সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তারা সারাদিন মাঠে পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বা কারো বাড়ির উঠোনে বসে আলাপচারিতায় মগ্ন হতেন। একে অপরের খোঁজখবর রাখতেন, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতেন। এই আন্তরিকতা ও সামাজিকতা গ্রামের মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য।
বৃদ্ধাশ্রমের ধারণাটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছে, এমন নজির খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, গ্রামে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন এবং মূল্যবোধ এখনো অনেক বেশি শক্তিশালী। পৃথিবীর বহু সম্মানী ব্যক্তির দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাদের অনেকেই গ্রামের সন্তান এবং জীবনের শেষ দিনগুলো তারা তাদের প্রিয় গ্রামেই কাটাতে চেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে তার নিজ গ্রাম কুনুতেই সমাহিত করা হয়েছিল। প্রত্যেক মানুষই চায়, তার শেষ নিঃশ্বাসটা যেন তার চেনা মাটির গন্ধেই মিশে যায়। তাই গ্রামের মানুষকে ঢালাওভাবে ‘টক্সিক’ বলাটা কেবল অকৃতজ্ঞতাই নয়, বরং নিজের শিকড়কে অস্বীকার করার সামিল।
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রামের মানুষেরা হয়তো শহরের মানুষের মতো এত চালাক-চতুর বা হিসেবি নয়, কিন্তু তারা কাউকে ঠকায় না, ঠকাতে জানে না। তাদের জীবনযাত্রা সরল, তাদের প্রতিশ্রুতিও সরল। গ্রামের পানি, মাটি, বায়ু এখনো শহরের তুলনায় অনেক বেশি বিশুদ্ধ। যেখানে শহরে প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, সেখানে গ্রামে এখনো পাখির ডাক শোনা যায়, রাতের আকাশে জোনাকির আলো আর অগণিত তারা দেখা যায়।
বাংলাদেশের অনেক কীর্তিমান সন্তানের জন্ম ও বিকাশ এই গ্রামেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কিংবদন্তী শিল্পী ফকির লালন শাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ অসংখ্য বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর উত্থান এই গ্রামীণ পটভূমি থেকেই। গ্রামের সেই মেঠো পথ, সেই সবুজ প্রকৃতি, সেই সহজ-সরল মানুষগুলোই তাদের চেতনায় জ্বালিয়েছে সৃজনশীলতার আলো।
পরিশেষে, শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের গানের কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে:
“শ্রমিক যেমন সবল হাতে, গড়েছে এদেশ দিনে রাতে,
ভিজে পুড়ে যেমন চাষী মাটির বুকে ফুটায় হাসি,
তেমনি হাজার কাজের মাঝে সুখের হাসি হাসতে হয়,
পদ্ম পাতার পানি নয়, দিনযাপনের গ্লানি নয়…”
এই গানের মতোই গ্রামের মানুষ হাজারো দুঃখ-কষ্টের মাঝেও মাটির বুকে হাসি ফোটায়, দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়। শহরের যে বিশাল অট্টালিকাগুলো আমরা দেখি, তার ইট-পাথর গাঁথা থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের সিংহভাগই সম্পন্ন করে গ্রামের দরিদ্র অথচ পরিশ্রমী মানুষগুলো।
তাই, কোনো একজন ইউটিউবারের ভিত্তিহীন মন্তব্যে প্রভাবিত না হয়ে আমাদের উচিত গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা। গ্রামকে ভালোবাসা, গ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, গ্রামই হলো বাংলাদেশের আসল পরিচয়, আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। এই মাটির ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। গ্রামের মানুষ ‘টক্সিক’ নয়, তারা এই দেশের প্রাণভোমরা, সভ্যতার আদি ও অকৃত্রিম ধারক।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।