
জীবিকার টানে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে পাড়ি জমান। তাঁদেরই একজন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রহিম উদ্দিন (ছদ্মনাম), যিনি রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পা রেখেছিলেন। তাঁর পাঠানো অর্থে পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছিল, সচ্ছলতা এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবর আসে, রহিম আর নেই। মরদেহের সাথে আসা মৃত্যুসনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা থাকলেও, দেশে ফেরার পর তাঁর শরীরে কিছু অস্বাভাবিক চিহ্ন পরিবারের মনে গভীর সন্দেহের জন্ম দেয়। রহিম উদ্দিনের মতো এমন হাজারো গল্প আজ সারাদেশের অসংখ্য পরিবারের। এই দেশের বহু সন্তান আজ প্রবাসী, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা কতটুকু? আর মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতি আমরা কতটা সুবিচার করতে পারছি?
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের ৩১ শতাংশেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ দুর্ঘটনায় এবং ১৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেন। মাত্র ২৮ শতাংশের মৃত্যু হয় স্বাভাবিকভাবে। বাকিরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। উদ্বেগের বিষয় হলো, মৃত প্রবাসী কর্মীদের পরিবারের প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) তাঁদের স্বজনের মৃত্যুসনদে উল্লিখিত কারণকে সঠিক বলে মনে করেন না। মরদেহে ক্ষতচিহ্ন, মৃত্যুর আগে ফোনে অস্বাভাবিক আলাপচারিতা, চিকিৎসার তথ্যের অভাব – এমন নানা কারণে তাঁদের এই অবিশ্বাস। ফলে, স্বজনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার আকুতি অসংখ্য পরিবারের হৃদয়ে আজ বোবা কান্না হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর প্রবাসে অভিবাসী মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। গত ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ জন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে ফেরত আনা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫৫২। আরও মর্মান্তিক বিষয় হলো, মৃতদের গড় বয়স মাত্র ৩৭ বছর – জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময়ে তাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ১৯৯৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৫৬ হাজার ৭৬৯ জন প্রবাসী কর্মীর নিথর দেহ দেশে ফিরেছে। এই সংখ্যাগুলো নিছক পরিসংখ্যান নয়, এর প্রতিটি অঙ্কের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ, প্রিয়জন হারানোর অসহনীয় বেদনা, যা ঘরে ঘরে আজ অনুভূত হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে সরকার কতটা আন্তরিক? যে দেশে আমাদের কর্মীরা তাঁদের শ্রম ও ঘাম ঝরাচ্ছেন, সেই দেশগুলোকে তাঁদের মৃত্যুর জন্য আদৌ কি জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে? প্রবাসী কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা ও তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের ভূমিকা আজ বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৃত্যুর পর তাঁদের মরদেহের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন, মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় এবং মৃতের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা – এ সবই রাষ্ট্রের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ঘাটতি প্রায়শই প্রকট হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা রক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থার অভাব, অমানবিক শারীরিক নির্যাতন, তীব্র তাপ ও ভয়াবহ বায়ুদূষণের মতো বৈরী পরিবেশে কাজ করার কারণে প্রবাসী কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর। বহু পরিবার জানে, তাঁদের সন্তান বা স্বামী কী নিদারুণ কষ্টে বিদেশে দিনাতিপাত করছেন। প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান এই পরিসংখ্যান রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দুর্বলতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
সরকারকে এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিদেশে কর্মরত প্রবাসী কর্মীদের, বিশেষত চট্টগ্রামের মতো অঞ্চল থেকে যাওয়া বিপুল সংখ্যক কর্মীর সুরক্ষায় কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বিদেশ থেকে ফেরত আসা প্রতিটি মরদেহের সাথে থাকা মৃত্যুসনদের তথ্যের সত্যতা যাচাই করা অপরিহার্য। প্রয়োজনে, দূতাবাস ও সরকারকে আন্তর্জাতিক মৃত্যুসংক্রান্ত প্রটোকল অনুসরণ এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিনিময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে হবে। এ ধরনের চুক্তি থাকলে বিদেশে কোনো অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য পাওয়া, তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের পথ অনেকটাই সুগম হবে।
দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে দেশে ফেরত আসা মরদেহের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা না গেলে কোন শ্রমবাজার আমাদের কর্মীদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না এবং দুঃখজনকভাবে প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকবে। তৃতীয়ত, যেসব দেশে বাংলাদেশী অভিবাসীদের মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মৃতের পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি স্থায়ী কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
প্রবাসে আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যাও আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। কোন অসহনীয় পরিস্থিতিতে পড়ে একজন মানুষ আত্মহননের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি। অভিবাসনের নানাবিধ মানসিক চাপ, কাজের অমানবিক পরিবেশ, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, চুক্তি লঙ্ঘন এবং দালাল চক্রের নির্মম প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক প্রবাসী কর্মী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং আত্মঘাতী পথ বেছে নেন।
এই প্রেক্ষাপটে, বিদেশে যাওয়ার আগে কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মসংস্থানের চুক্তির প্রতিটি শর্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সম্পূর্ণ বৈধ ও নিরাপদ পথে বিদেশ গমনের ব্যবস্থা করা এবং দূতাবাস ও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর কার্যক্রমের ওপর কঠোর তদারকি জোরদার করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এভাবে প্রবাসে অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে তা স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষকে বিদেশে কর্মসংস্থানের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করবে, যা আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য শুভকর হবে না।
প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত আরেকটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও মৌলিক সমস্যা হলো ঢাকার বিমানবন্দরে তাঁদের মরদেহ গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় চরম অপমানজনক ও অসংবেদনশীল আচরণের অভিযোগ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মরদেহ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবারকে নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতা ও অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে দূরবর্তী কোনো গ্রাম থেকে আসা একটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষে এই জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যে কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়। এই অমানবিক পরিস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দ্রুত নিরসন এবং পুরো প্রক্রিয়াটিকে পরিবারবান্ধব করে তোলা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে, বিদেশে অবস্থিত আমাদের দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোকে আরও অনেক বেশি সক্রিয়, সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রায়শই দেখা যায়, কোনো অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট দূতাবাস প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তদন্ত করে না, স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন সংগ্রহে তৎপর হয় না, কিংবা শোকাহত পরিবারের সঙ্গে কার্যকর ও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে না। এই উদাসীনতার কারণেও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে পরিবারের সদস্যরা অন্ধকারে থেকে যান। অথচ এই দূতাবাসগুলোই হতে পারত বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিকদের জীবনের প্রধান সুরক্ষা বলয়, তাঁদের আস্থার শেষ আশ্রয়স্থল।
সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যুকে ঘিরে স্বচ্ছতা, মানবিকতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে। অভিবাসীদের মৃত্যুর বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রাপ্তি, মরদেহ যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে দেশে ফেরত আনা এবং শোকাহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান – এই মৌলিক বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা যদি রাষ্ট্র দিতে না পারে, তবে দেশের সামগ্রিক অভিবাসন ব্যবস্থাপনার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না। অন্যথায়, চট্টগ্রামের রহিম উদ্দিনদের মতো আরও অসংখ্য প্রবাসী কর্মীর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে, আর তাঁদের স্বজনদের আর্তি কেবলই প্রতিধ্বনিত হবে। আমরা এই দাবি জানাচ্ছি, প্রতিটি প্রবাসী কর্মীর জীবনের মূল্য নিশ্চিত হোক, তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।