বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ঘুম যেভাবে বদলে দেবে আমাদের জীবন

এ কে এম ফজলুল করিম | প্রকাশিতঃ ১০ জুন ২০২৫ | ৬:২৩ অপরাহ্ন


গভীর রাত। চারপাশের কোলাহল থেমে গিয়ে পৃথিবী যখন নিস্তব্ধ, আপনি ঘুমের অতল গভীরে ডুব দেন। কিন্তু এই ঘুম কি শুধুই সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার একটি জৈবিক প্রক্রিয়া? যদি বলি, আপনার এই ঘুমের মধ্যেই ঘটে চলেছে এক নীরব বিপ্লব, যা আমাদের চেনা পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে আমূল বদলে দেবে? শুনতে হয়তো কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প মনে হচ্ছে, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ঘুমের সেই রহস্যময় জগতে প্রবেশ করে এক নতুন বাস্তবতার দরজা খুলে দিচ্ছে। সেই জগতে ঘুম আর কেবল বিশ্রাম নয়, বরং জ্ঞানার্জন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর সৃজনশীলতার এক আশ্চর্য কারখানা।

আমরা সাধারণত ঘুমকে জীবনের একটি নিষ্ক্রিয় অধ্যায় হিসেবেই দেখি। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ঘুমন্ত অবস্থাতেও আমাদের শরীর ও মস্তিষ্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করে চলে। ঘুমের মূলত দুটি প্রধান পর্যায় রয়েছে। একটি হলো নন-রেম (NREM) ঘুম, যখন আমাদের শরীর নিজেকে মেরামত করে, নতুন কোষ তৈরি করে আর ভবিষ্যতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে। অন্যটি হলো রেম (REM) ঘুম—এই পর্যায়ে মস্তিষ্ক অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে, আমরা স্বপ্ন দেখি, এবং সারাদিনের সংগৃহীত তথ্য ও স্মৃতিগুলোকে তা গুছিয়ে রাখে। এই প্রক্রিয়াটি শেখার জন্য অপরিহার্য। যখন আমরা পর্যাপ্ত ঘুমাই না, তখন শুধু আমাদের শরীরই ক্লান্ত হয় না, আমাদের মনোযোগ, মেজাজ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ঘুমের অভাব উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং হৃদরোগের মতো ভয়াবহ সব রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই সত্যগুলো জানার পরও আমাদের আধুনিক সমাজ ঘুমকে অবহেলার চোখেই দেখে এসেছে। ‘কম ঘুমাও, বেশি কাজ করো’—এই ধারণাটি সফলতার মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন এই বিপজ্জনক ধারণাকে ভেঙে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।

গত এক দশকে ‘স্লিপ টেক’ বা ঘুম-প্রযুক্তি নামে এক নতুন এবং সম্ভাবনাময় শিল্পের উত্থান ঘটেছে। আমাদের হাতের স্মার্টওয়াচ বা মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপ (যেমন Sleep Cycle, Calm) এখন আমাদের ঘুমের প্রতিটি মুহূর্তকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। কতক্ষণ ঘুমালাম, সেই ঘুম কতটা গভীর ছিল, হৃদস্পন্দন কেমন ছিল—এই সব তথ্য এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। এই ডেটা আমাদের ঘুমের অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে এবং কোথায় উন্নতি প্রয়োজন তা বুঝতে সাহায্য করছে। আবার এমন স্মার্ট ম্যাট্রেস তৈরি হয়েছে যা আপনার শরীরের তাপমাত্রা অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে; বা এমন স্মার্ট বালিশ যাতে রয়েছে বিল্ট-ইন স্পিকার, যা আপনাকে স্নিগ্ধ সুর শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে সাহায্য করে। এমনকি গুরুতর স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীদের জন্য সিপ্যাপ মেশিন শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ঘুমের মান নাটকীয়ভাবে উন্নত করছে। এগুলো তো গেল বর্তমানের কথা। ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য আরও অনেক বেশি বিস্ময়কর এক অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছে।

ভবিষ্যতে ঘুম আর কেবল একটি নিষ্ক্রিয় কাজ থাকবে না, বরং এটি হয়ে উঠবে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের এক সক্রিয় কর্মক্ষেত্র। একবার কল্পনা করুন, আপনি রাতে ঘুমাতে গেলেন আর সকালে উঠে দেখলেন একটি নতুন ভাষার অনেকগুলো শব্দ আপনার অবচেতন মনে গেঁথে গেছে! ‘স্লিপ লার্নিং’-এর এই ধারণাটি আর কল্পনা নয়, বরং বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে কাজ করছেন। প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যেখানে ঘুমের গভীর NREM পর্যায়ে বিশেষ অডিও বার্তার মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্কে নতুন তথ্য বা দক্ষতা প্রবেশ করানো সম্ভব হবে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনাকে আরও সহজ করে তুলবে, পেশাজীবীরা ঘুমের মধ্যেই নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন, আর বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও এটি সাহায্য করবে।

শুধু তাই নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই আপনার ব্যক্তিগত ‘স্লিপ কোচ’ বা ঘুম প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করবে। আপনার জিনগত বৈশিষ্ট্য, সারাদিনের কাজের ধরন, খাদ্যাভ্যাস এবং ঘুমের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে এআই বলে দেবে, আপনার জন্য ঠিক কত ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন, কোন পরিবেশে ঘুমালে সবচেয়ে ভালো ফল পাবেন, বা কোন খাবার আপনার ঘুমের গভীরতা বাড়াবে। এটি হবে আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আবার আমরা জানি, রেম ঘুম সৃজনশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি হয়তো আমাদের রেম ঘুমকে দীর্ঘায়িত বা প্রভাবিত করার সুযোগ করে দেবে। তখন হয়তো কোনো স্থপতি তার সেরা ডিজাইনের ধারণাটি ঘুমের মধ্যেই পেয়ে যাবেন, বা কোনো বিজ্ঞানী তার জটিল গবেষণার সমাধান খুঁজে বের করবেন স্বপ্নের জগতে।

এই যাত্রার সবচেয়ে বৈপ্লবিক এবং কিছুটা রোমাঞ্চকর সম্ভাবনাটি লুকিয়ে আছে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তির মধ্যে। এর মাধ্যমে আমরা সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের ঘুমের প্যাটার্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। অনিদ্রায় ভুগছেন? একটি ছোট্ট ডিভাইস মৃদু বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠিয়ে আপনাকে মুহূর্তেই গভীর ঘুমে নিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ‘পাওয়ার ন্যাপ’কে আরও কার্যকর করা সম্ভব হবে, এমনকি হয়তো স্বপ্নের বিষয়বস্তুও আংশিকভাবে প্রভাবিত করা যাবে।

তবে প্রযুক্তির এই স্বর্ণালী ভবিষ্যতেরও একটি অপর পিঠ রয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো আমাদের সামনে কিছু গুরুতর নৈতিক এবং বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আমাদের ঘুমের ব্যক্তিগত ডেটা কতটা সুরক্ষিত থাকবে? কোনো বাণিজ্যিক বা অসাধু চক্র কি এই ডেটার অপব্যবহার করতে পারে? এই প্রযুক্তি কি কেবল ধনী শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সবার জন্য সহজলভ্য হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে সরাসরি প্রভাবিত করার দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো কী কী হতে পারে? আমরা কি ঘুমের জন্য প্রযুক্তির ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ব যে প্রাকৃতিক ঘুম আমাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে? ভবিষ্যতের পথে এগোনোর জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি।

তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এই প্রযুক্তিগত বিপ্লব আমাদের ঘুম সম্পর্কিত মানসিকতা পরিবর্তনে বাধ্য করবে। ঘুমকে আর অলসতা বা সময় নষ্ট হিসেবে দেখা হবে না। বরং একটি সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমকে অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হবে। ঘুম তখন আর কেবল একটি জৈবিক প্রয়োজন থাকবে না, এটি হয়ে উঠবে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা যা আমাদের শেখার, সুস্থ থাকার এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তাই আপনার আজকের ভালো ঘুমকে অবহেলা করবেন না, কারণ এটিই হতে পারে আপনার এবং আমাদের সবার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।