বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কি একটি মৃত্যুফাঁদ?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১২ জুন ২০২৫ | ১০:১৬ পূর্বাহ্ন


প্রতিটি ছুটির দিনে, বিশেষ করে ঈদের লম্বা অবসরে, নগরজীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যান কক্সবাজারে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বিশালতাকে অনুভব করা আর প্রিয়জনদের সঙ্গে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠার মুহূর্তগুলো জীবনের সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকার কথা।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই আনন্দের ভ্রমণ ক্রমবর্ধমানভাবে এক ভয়াবহ বিষাদে রূপ নিচ্ছে। এবারের ঈদের ছুটিতে মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ছয়জন তরতাজা প্রাণের বিনাশ ঘটেছে সমুদ্রের অথৈ জলে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এক ভয়ংকর বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি। যে পর্যটকদের ঘিরে কক্সবাজারের অর্থনীতি আবর্তিত হয়, সেই পর্যটকদের জীবনের নিরাপত্তাই আজ সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত।

আমরা গর্ব করে কক্সবাজারকে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত বলি, কিন্তু এর সুরক্ষার করুণ দশা আমাদের জন্য লজ্জার। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিশাল তটরেখার মাত্র পাঁচ কিলোমিটার এলাকা, অর্থাৎ সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী পয়েন্ট, নামমাত্র নিরাপত্তার আওতায় রয়েছে। বাকি বিশাল এলাকা সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং মৃত্যুকূপ বললেও ভুল হবে না। হিমছড়ি, ইনানী, দরিয়ানগর বা টেকনাফের মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে, অথচ সেখানে নেই কোনো সমন্বিত উদ্ধার বা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা।

পর্যটকদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ‘গুপ্তখাল’ বা ‘রিপ কারেন্ট’, যা সমুদ্রের একটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক ফাঁদ। সৈকতের কাছাকাছি কোনো স্থানে ঢেউয়ের মাধ্যমে জমে থাকা পানি যখন সরু পথ দিয়ে তীব্র বেগে সাগরের গভীরে ফিরে যায়, তখন এই স্রোতের সৃষ্টি হয়। সাধারণ পর্যটকদের পক্ষে এই গুপ্তখালের উপস্থিতি বোঝা প্রায় অসম্ভব। কোনো বিপদসংকেত বা নির্দেশনা না থাকায় তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর মুখে পতিত হন।

কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। এই খাত থেকে সরকার, হোটেল-মোটেল মালিক এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেন। অবাক করা বিষয় হলো, যে পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে এই বিপুল অর্থ উপার্জন, তাদের জীবনের নিরাপত্তায় এই আয়ের সামান্য অংশও বিনিয়োগ করা হয় না। এটি কেবল অবহেলা নয়, এক ধরনের অমার্জনীয় উদাসীনতা।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বছরে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে একটি আধুনিক ও সমন্বিত নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা কি সত্যিই অসম্ভব? কয়েকটি মনিটরিং টাওয়ার, একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কন্ট্রোল রুম, দ্রুতগামী উদ্ধারকারী বোট এবং একটি প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড ইউনিট গঠন করতে যে অর্থের প্রয়োজন, তা এই খাতের মোট আয়ের তুলনায় অতি নগণ্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সেখানে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর লাইফগার্ড টাওয়ার, প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড, নিরাপদ সাঁতারের এলাকা বা ‘সেফ সুইমিং জোন’ এবং পতাকার মাধ্যমে বিপদ সংকেত জানানোর ব্যবস্থা থাকে। প্রায় এক যুগ আগে কক্সবাজারেও জাল দিয়ে একটি নিরাপদ জোন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নিম্নমানের কাজের কারণে সেই প্রকল্প কয়েক মাসেই সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। সেই ব্যর্থতার পর আর কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

এই পরিস্থিতির দায় কোনো একক পক্ষের নয়। একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সর্বপ্রথম, সরকারকে একটি ‘কক্সবাজার পর্যটন নিরাপত্তা মহাপরিকল্পনা’ গ্রহণ করতে হবে। এই পরিকল্পনার আওতায় পুরো সৈকতকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে লাইফগার্ড টাওয়ার, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র এবং জরুরি উদ্ধার সরঞ্জাম নিশ্চিত করা জরুরি।

এর পাশাপাশি হোটেল মালিকদেরও দায়বদ্ধ হতে হবে। তাদের শুধু ব্যবসা নিয়ে ভাবলে চলবে না, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নিরাপত্তায় অবদান রাখতে হবে। সকল হোটেল মালিকদের অংশগ্রহণে একটি ‘পর্যটক সুরক্ষা তহবিল’ গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা উদ্ধার সরঞ্জাম কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণে কাজে লাগবে।

সচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি। সৈকতের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে স্থায়ী বিপদ সংকেত ও সাইনবোর্ড লাগাতে হবে। জোয়ার-ভাটার সময় এবং গুপ্তখালের বিপদ সম্পর্কে মাইকিংয়ের মাধ্যমে পর্যটকদের প্রতিনিয়ত সতর্ক করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। ড্রোনের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, যা বিপদে পড়া পর্যটকের অবস্থান দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।

মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজারে যায় একটুখানি শান্তি ও আনন্দের জন্য, লাশ হয়ে ফেরার জন্য নয়। প্রতিটি মৃত্যুই একটি অপূরণীয় ক্ষতি। ‘ভাগ্য’ বা ‘নিজ দোষে দুর্ঘটনা’ বলে এই দায় এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সময় এসেছে মুনাফার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের জীবনকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়ার। কক্সবাজারের সৈকতে আর একটিও প্রাণের বিনাশ আমরা দেখতে চাই না।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।