বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৩ জুন ২০২৫ | ৭:১১ অপরাহ্ন


মধ্যপ্রাচ্যের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ। কয়েক দশকের ছায়াযুদ্ধ এবং চোরাগোপ্তা হামলা শেষে ইরান ও ইসরায়েল এক সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ শুক্রবার ভোরে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে এক ভয়াবহ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান, রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান এবং শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীসহ দেশটির সামরিক ও পারমাণবিক কর্মসূচির মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই নজিরবিহীন হামলার পর পুরো অঞ্চলে চূড়ান্ত সংঘাতের সাইরেন বেজে উঠেছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম অনুসারে, এই হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং দেশের শীর্ষ দুই পরমাণু বিজ্ঞানী ফারেদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তেহরানের পারমাণবিক অবকাঠামো এবং পারমাণবিক বোমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করেই এ হামলা চালানো হয়েছে। হামলার পর ইরানের পাল্টা আঘাতের আশঙ্কায় ইসরায়েলজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।

এই হামলার সময়টিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ওমানে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের ঠিক একদিন আগেই এই অভিযান চালানো হলো। যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযানে কোনো ধরনের সহায়তা করার কথা অস্বীকার করলেও, হামলার মাত্র একদিন আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, “অঞ্চলটি বিপজ্জনক হতে পারে।”

যেভাবে কয়েক দশকের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিল

ইসরায়েল ও ইরানের শত্রুতা নতুন নয়, এর শেকড় প্রোথিত কয়েক দশকের গভীরে। স্থল, সমুদ্র, আকাশ এবং সাইবার জগতে চলমান তাদের এই গোপন সংঘাত ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে।

বিপ্লব থেকে শত্রুতা: ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ইরানের পশ্চিমাপন্থী শাসক মোহাম্মদ রেজা শাহ ছিলেন ইসরায়েলের মিত্র। কিন্তু বিপ্লবের পর ইরানে প্রতিষ্ঠিত শিয়াপন্থী ধর্মতন্ত্রের অন্যতম মূল ভিত্তিই ছিল ইসরায়েলবিরোধিতা, যা দুই দেশকে চিরশত্রুতে পরিণত করে।

প্রক্সি যুদ্ধের সূচনা: ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের মদদে সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর জন্ম হয়, যা পরবর্তীতে সীমান্তে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে লেবাননে ইসরায়েলি সামরিক সদর দপ্তরে আত্মঘাতী হামলা এবং ১৯৯২-৯৪ সালে আর্জেন্টিনায় ইসরায়েলি দূতাবাসে হামলার জন্য ইরান ও হিজবুল্লাহকে দায়ী করে ইসরায়েল।

পারমাণবিক উচ্চাভিলাষ ও গুপ্তহত্যা: ২০০২ সালে ইরানের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি ফাঁস হওয়ার পর নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। ইসরায়েল একে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে দেখে এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর বৈশ্বিক পদক্ষেপের আহ্বান জানায়। ২০১০ সালে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস ব্যবহার করে চালানো সাইবার হামলা এবং ২০১২ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি-রোশন ও ২০২১ সালে কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী মোহসেন ফখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে ইরান অভিযোগ করে আসছে।

প্রকাশ্য সংঘাতের পথে: ২০১৮ সাল থেকে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলি হামলা এবং ২০২০ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান।

২০২৪-২৫: পাল্টাপাল্টি হামলায় চূড়ান্ত অবনতি

২০২৩ সালে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি হামলায় আইআরজিসির সিনিয়র কমান্ডাররা নিহত হন। এর প্রতিশোধ হিসেবে ১৩ এপ্রিল ইরান প্রথমবারের মতো সরাসরি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

এই সংঘাত আরও তীব্র হয় যখন লেবাননে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ (সেপ্টেম্বর ২০২৪) এবং তেহরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে (জুলাই ২০২৪) হত্যা করা হয়। এর প্রতিশোধ নিতে গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। জবাবে ইসরায়েলও ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় সীমিত আকারে বিমান হামলা চালায়।

আজকের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ সেই ধারাবাহিক সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ ও চূড়ান্ত পর্ব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যকে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিল, যার পরিণতি হতে পারে এক দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী আঞ্চলিক যুদ্ধ।