বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

শিক্ষা খাতে বাজেট: বরাদ্দ বাড়ে, মান কেন বাড়ে না?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১৫ জুন ২০২৫ | ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন


প্রতি বছর বাজেট আসে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এই খাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। একটি দাবি প্রতিবারই ওঠে—শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সরকার বরাদ্দ কিছুটা বাড়ায়ও। কিন্তু আমাদের শিক্ষার মান কি আদৌ বাড়ে? আসল সংকটটা কি শুধু টাকার?

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই অঙ্কটি মোট বাজেটের মাত্র ১২ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরেই এই হার ১২ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। তবে মূল সমস্যা বরাদ্দের পরিমাণে নয়, বরং এর ব্যবহারে। এই বিপুল পরিমাণ টাকার সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে। বাকি টাকার একটি বড় অংশ খরচ হয় নতুন ভবন নির্মাণ ও সংস্কারের মতো অবকাঠামোগত কাজে। এই দুটি খাতের প্রয়োজন আছে, কিন্তু শিক্ষার মানের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক পরোক্ষ।

শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যে খাতগুলোতে টাকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানেই বরাদ্দ সবচেয়ে কম। যেমন, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম তৈরি করা, মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক লেখা এবং আধুনিক শিখনসামগ্রী তৈরি করার জন্য বরাদ্দ থাকে খুবই সামান্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্যও টাকার পরিমাণ হতাশাজনক। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। মেধাবী শিক্ষকরা এসব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর যারা করছেন, তাদের বেশিরভাগই দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনায় যে বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ শিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান মিছিল। প্রতি বছর আমরা হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত তরুণ তৈরি করছি। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জ্ঞান ও দক্ষতার কোনো সুফল পাচ্ছে না। চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে এই তরুণদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। এর কারণ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের বাজারের জন্য দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারছে না।

এই ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার দুষ্টচক্র। শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভবন নির্মাণের মতো উন্নয়নমূলক কাজে দুর্নীতির খবর সংবাদমাধ্যমে হামেশা চোখে পড়ে। আমরা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে ভুলে ভরা, নিম্নমানের কাগজে ছাপা বই তুলে দিতেও দ্বিধা করি না। এটি আমাদের গাফিলতির এক করুণ নমুনা।

আমাদের অগ্রাধিকারগুলোও যেন ভুল পথে চালিত হচ্ছে। আমরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে আমাদের কোনো নজর নেই। একটি দেশের শিক্ষার মান কয়েকটি নতুন ভবনের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা, উদ্ভাবন আর শিক্ষার পরিবেশের ওপর।

শিক্ষাবিদরা বারবার বলছেন, ক্লাসরুমের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শিক্ষকরা কোচিং আর প্রাইভেট পড়ানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। শিক্ষার্থীরাও বাজারের গাইড বই ছাড়া পড়াশোনার কথা ভাবতে পারে না। কেন এই পরিস্থিতি? কেন শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়ার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের শিক্ষকদেরই দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঠদান পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল। আমরা এখনো কেন সেটি করতে পারলাম না? কেন আমাদের মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন? কেন উচ্চতর গবেষণায় আমরা পিছিয়ে আছি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না।

শিক্ষা এখন ধীরে ধীরে একটি দামি ‘পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। বাজেটের এই বরাদ্দ দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা বয়ে আনছে না। সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষা আমাদের শিক্ষিত করছে বটে, কিন্তু দক্ষ করছে না। এর চূড়ান্ত পরিণতি হলো ‘ব্রেন ড্রেন’ বা মেধা পাচার। দেশের সেরা মেধাবীরা এখন আর দেশে থাকতে চাইছেন না। ভালো চাকরি আর গবেষণার সুযোগ খুঁজতে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। এই সংকটগুলো থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো মৌলিক বা নতুন পরিকল্পনা আমাদের নেই। বাজেটেও তার কোনো দিকনির্দেশনা থাকে না।

শিক্ষার সঙ্গে একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক নিবিড়। কিন্তু আমরা সেই সম্পর্কের পথরেখাটি স্পষ্ট করতে পারিনি। ফলে বাজেটে শিক্ষা খাত বছরের পর বছর অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। এর দায় যতটা না অর্থনীতিবিদদের, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।

তাই এখন সময় এসেছে শুধু বরাদ্দের দিকে না তাকিয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়ার। শিক্ষার সার্বিক সংস্কারের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা বিদ্যমান সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করবে এবং সমাধানের পথ বাতলে দেবে। শিক্ষার রূপান্তরকে দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একটি সুস্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া শুধু বরাদ্দ বাড়ানো অনেকটা ফুটো পাত্রে জল ঢালার মতো। তাতে পাত্র কোনোদিনও ভরবে না।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।