
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাতাস এখন শুধু শহরের উঁচু দালান বা কারখানার যন্ত্রপাতিতে সীমাবদ্ধ নেই; এর ঢেউ পৌঁছে গেছে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষিক্ষেত্রেও। একসময় যা ছিল কল্পবিজ্ঞানের বিষয়, তাই এখন বাস্তবতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকস বদলে দিচ্ছে হাজার বছরের পুরোনো চাষাবাদের চিত্র। এই পরিবর্তনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো ‘এগ্রিবট’ (AgriBot)—একটি আধুনিক রোবটিক কৃষি সহকারী, যা স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজকে আরও লাভজনক, টেকসই ও বিজ্ঞাননির্ভর করে তুলছে।
এগ্রিবট মূলত একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, যা একজন দক্ষ কৃষকের মতোই কাজ করতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি নির্ভুলভাবে। স্যাটেলাইট সংযোগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদম এবং উন্নত সেন্সর প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি মাঠের প্রতিটি অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। এর কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে সেই অনুযায়ী বীজ বপন করা, আগাছা শনাক্ত করে নির্মূল করা, নিখুঁতভাবে সেচ নিয়ন্ত্রণ এবং কখন ফসল কাটার জন্য পরিপক্ব হয়েছে, তা শনাক্ত করা। এমনকি কিছু রোবট ড্রোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে ফসলের রোগবালাই শনাক্ত করতে পারে এবং কেবল আক্রান্ত স্থানেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করে।
এর ফলাফল চমকপ্রদ। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এগ্রিবট ব্যবহারে প্রতি একরে গড় উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, একজন কৃষক যেখানে দিনে এক একর জমিতে কাজ করতে পারেন, সেখানে একটি এগ্রিবট প্রায় দশ একর জমিতে কাজ করতে সক্ষম। এতে সময় ও শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন কমে, তেমনি সামগ্রিক খরচও প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। এর ফলে কৃষক যেমন লাভজনক ফলন পান, তেমনি নির্দিষ্ট পরিমাণে সার, পানি ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও কমে আসে।
এই প্রযুক্তি এখন আর পরীক্ষামূলক পর্যায়ে নেই। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিকের সংকট মোকাবিলায়, এগ্রিবট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরালা ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলোতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং ফলাফল অত্যন্ত ইতিবাচক। বাংলাদেশেও কিছু স্টার্টআপ, যেমন ‘আইফার্মার’ (iFarmer) ও ‘কৃষকবন্ধু’ (Krishok Bondhu), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কৃষি সহায়তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে, যা প্রমাণ করে যে আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেবল ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধিই কি এই ব্যয়বহুল প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য যথেষ্ট? উত্তর হলো—হ্যাঁ। কারণ এই বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আরও অনেকগুলো সম্মিলিত সুবিধা: সাশ্রয় হওয়া সময়, কমে আসা শ্রম ও উপকরণের খরচ, উন্নত মানের ফসল এবং ডেটা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার সুযোগ। একটি এগ্রিবট কেনা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যয়বহুল মনে হলেও, এটি বছরের পর বছর সেবা দিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে একে একটি লাভজনক ও টেকসই বিনিয়োগে পরিণত করে।
বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিনির্ভর দেশের জন্য এগ্রিবটের মতো প্রযুক্তি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। আমাদের কৃষির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো—যেমন শ্রমিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং উপকরণের ক্রমবর্ধমান মূল্য—মোকাবিলায় এই প্রযুক্তি হতে পারে এক কার্যকর সমাধান। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যদি এই প্রযুক্তিকে সমর্থন দেওয়া হয় এবং কৃষকদের জন্য সাবসিডির ব্যবস্থা করা হয়, তবে তা একটি টেকসই কৃষিবিপ্লবের সূচনা করতে পারে।
রোবট যখন কৃষকের সহকারী হয়ে মাঠে নামে, তখন কৃষিকাজ কেবল কায়িক শ্রমনির্ভর থাকে না, হয়ে ওঠে জ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক। বাংলাদেশে যদি সময়মতো এই প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করা যায়, তাহলে কেবল খাদ্য উৎপাদনই বাড়বে না, কৃষকদের জীবনযাত্রার মানও বদলে যাবে। নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা যদি কৃষিকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন, তবে আমাদের কৃষিক্ষেত্রেও ঘটবে এক নীরব বিপ্লব—আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের চাবিকাঠি।