মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ আজ যুদ্ধের কালো মেঘে ঢাকা। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছে, তা কেবল দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি পুরো অঞ্চলকে এক ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী মহাদুর্যোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির একেবারে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো। তারা আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, যেখানে একটি ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। তাদের সামনে পথ দুটি—হয় তারা এই অঞ্চলের কৌশলগত চালকের আসনে বসে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নির্ধারণ করবে, নতুবা অন্যদের তৈরি করা সংঘাতের ধ্বংসস্তূপ সরানোর করুণ দায়িত্ব পালন করবে। নিষ্ক্রিয় থাকার বিলাসিতা এখন আর তাদের জন্য নেই।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে নিজেদের সামরিক ও কৌশলগত মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের ব্যয়বহুল যুদ্ধে ক্লান্ত আমেরিকা তার নীতি পরিবর্তন করতে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ‘এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোড় ঘোরানো’ (পিভট টু এশিয়া) নীতির মাধ্যমে। পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দর্শন এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় মিত্ররা একটি স্পষ্ট বার্তা পায়—তাদের নিরাপত্তার জন্য আর আগের মতো আমেরিকার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না।
এই পরিস্থিতি উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য একটি অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করেছিল। এত দিন তারা ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার নিচে থাকা ধনী পৃষ্ঠপোষক বা অর্থের জোগানদাতা। কিন্তু আমেরিকার এই কৌশলগত পশ্চাদপসরণ তাদের সামনে এই অঞ্চলের প্রধান কৌশলপ্রণেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ এনে দেয়। কাতার, ওমান আর সৌদি আরবের মতো দেশগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগানোর একটি প্রশংসনীয় চেষ্টাও শুরু করেছিল। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য দূতের সঙ্গে মিলে ইরানের সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তির কাঠামো তৈরির পথে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধু পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নয়, বরং অর্থনৈতিক সংযুক্তি, বাণিজ্য এবং সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পুরো অঞ্চলে এক নতুন শান্তি ও স্থিতিশীলতার অধ্যায় রচনা করা। এটি হতে পারত এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে যুদ্ধের জায়গা নিত পারস্পরিক নির্ভরতা।
কিন্তু উপসাগরীয় দেশগুলোর এই আশাবাদী পরিকল্পনা একটি কঠিন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিল—আর তা হলো ইসরায়েল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার পুরনো সব কৌশল ঝেড়ে ফেলে এক চূড়ান্ত আগ্রাসী রূপ ধারণ করেন। গাজা এবং লেবাননে হিজবুল্লাহকে আংশিকভাবে দুর্বল করার পর তিনি এবার তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইরানের গভীরে আঘাত হানা শুরু করেছেন। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার—ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যেকোনো সমঝোতার সম্ভাবনাকে চিরতরে সমাহিত করা।
এই যুদ্ধ শুরু করে নেতানিয়াহু তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট থেকে মনোযোগ যেমন সরিয়েছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের প্রভাবও ফিরে পেয়েছেন। তিনি সফলভাবে ট্রাম্প প্রশাসনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে টেনে এনেছেন, যা উপসাগরীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক উদ্যোগকে পুরোপুরি ভণ্ডুল করে দিয়েছে। এই বাস্তবতায় উপসাগরীয় দেশগুলো যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
১৯৭৩ সালের তেল-সংকটের সময় সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যেভাবে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করেছিল, আজ তাদের হাতে তার চেয়েও বহুগুণ বেশি অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং জ্বালানি-সম্পর্কিত শক্তি রয়েছে। বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিতে তাদের শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানি বাজারের ওপর তাদের প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু তারা সেই শক্তি ব্যবহার করতে নারাজ। তারা এখনো লেনদেনভিত্তিক কূটনীতিতেই বিশ্বাসী। তারা ভাবছে, ট্রাম্পকে কিছু লোভনীয় বিনিয়োগ বা জ্বালানি চুক্তি দিয়েই সন্তুষ্ট রাখা যাবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না যে, ইসরায়েল যখন সরাসরি সামরিক শক্তি, গোয়েন্দা তৎপরতা এবং ওয়াশিংটনের রাজনীতিতে তার গভীর প্রভাব ব্যবহার করে মার্কিন নীতিকে নিজেদের পক্ষে চালিত করছে, তখন এই নরম কৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এই সংঘাত যদি বর্তমান পথেই এগোতে থাকে, তার ভবিষ্যৎ চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই ইরানে পুরোদস্তুর স্থলসেনা পাঠিয়ে দখলদারিত্ব কায়েম করবে না। তারা বেছে নিয়েছে এক দীর্ঘমেয়াদি ও যন্ত্রণাদায়ক কৌশল—‘একটু একটু করে দুর্বল করার’ নীতি। একের পর এক সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে, বিজ্ঞানী ও সামরিক নেতাদের হত্যা করে ইরানকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে তোলাই তাদের লক্ষ্য।
যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এই সংঘাতে নিহত হন, তবে দেশটিতে এক ভয়াবহ উত্তরাধিকার সংকট শুরু হবে। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি), নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হতে পারে হয়তো একটি কঠোর সামরিক স্বৈরশাসন, অথবা আরও ভয়ংকর কিছু—একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র।
আর ইরান যদি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তার প্রথম ও সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হবে উপসাগরীয় দেশগুলোই। তাদের দোরগোড়ায় থাকবে এক বিধ্বস্ত প্রতিবেশী, ভাঙা ও নিয়ন্ত্রণহীন সীমান্ত, লাখ লাখ শরণার্থীর স্রোত এবং অসংখ্য সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক। হিজবুল্লাহ, হুতি বা ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো তখন অভিভাবকহীন হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ইসরায়েল হয়তো মাঝে মাঝে ড্রোন হামলা চালিয়ে এদের কাউকে হত্যা করবে, কিন্তু এই অঞ্চলে আর কখনোই স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। উপসাগরীয় দেশগুলোকে তখন এক অন্তহীন অস্থিতিশীলতার বোঝা কাঁধে নিয়ে বাঁচতে হবে।
সুতরাং, উপসাগরীয় দেশগুলোকে এখন এই আত্মঘাতী নিষ্ক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, শুধু অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক দাবা খেলায় টিকে থাকা যাবে না। তাদের কৌশলগত খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে।
প্রথমত, তাদের উচিত ওয়াশিংটনে নতুন করে, আরও শক্তিশালীভাবে লবি গড়ে তোলা। ট্রাম্প প্রশাসনকে এটা বোঝাতে হবে যে, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যও জরুরি এবং সংঘাতের পথ থেকে সরে এসে কূটনীতির পথে হাঁটতে তাদের চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব এখন বহু মেরুর। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একক নির্ভরতা কমিয়ে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাবিষয়ক অংশীদারত্বকে একটি কৌশলগত ভারসাম্য তৈরির কাজে ব্যবহার করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে হবে যে, উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতে অন্য বিকল্পও রয়েছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতে শক্তি আছে, সামর্থ্যও আছে। এখন প্রয়োজন শুধু সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। হয় তারা এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিজেরা গড়বে, নয়তো অন্যদের তৈরি করা আগুনে পুড়ে ছাই হবে। তৃতীয় কোনো পথ আর খোলা নেই।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।