
ঈদের আনন্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই সাধারণ মানুষের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। পবিত্র রোজা থেকে শুরু করে ঈদুল আজহা পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাজার, বিশেষ করে চালের বাজার, মোটামুটি স্থিতিশীল থাকায় দেশের গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু সেই স্বস্তি উধাও হতে সময় লাগল না। ঈদের সপ্তাহখানেক পার না হতেই কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে চড়তে শুরু করেছে চালের দাম। এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির আঘাতে নতুন করে অস্বস্তি ও উদ্বেগে পড়েছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, ভরা মৌসুমে রেকর্ড ফলনের পরও কেন চালের বাজার এমন অস্থির? এর নেপথ্যে কারা?
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানেই ধরনভেদে প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। যে মিনিকেট চাল কিছুদিন আগেও নাগালের মধ্যে ছিল, তার দাম কেজিতে ছয় থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। শুধু চিকন চালই নয়, গরিব মানুষের প্রধান অবলম্বন মোটা ও মাঝারি চালের দামও কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি হয়তো অনেকের কাছে সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মাসিক হিসাবে এর প্রভাব বিশাল। পাইকারি বাজারেও জিরাশাইল ও কাটারিভোগ ধানের দাম মণপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব এসে পড়েছে চালের দামে।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম হলো, সরবরাহ কম ও চাহিদা বেশি থাকলে পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাজারে চালের কোনো সংকট নেই, বরং সরবরাহ পর্যাপ্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে রেকর্ড দুই কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের কৃষকেরা এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। অর্থাৎ, বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার মতো কোনো প্রাকৃতিক বা সরবরাহগত কারণই ঘটেনি। তাহলে এই ভরা মৌসুমে এমন মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী?
বাজার বিশ্লেষক এবং কৃষি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর পেছনে একটি অশুভ চক্রের কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, এটি একটি কৃত্রিম সংকট, যা তৈরি করেছে একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মিলমালিক। এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি একটি পুরোনো খেলাতেই মেতে উঠেছে। তারা মৌসুমের শুরুতেই, যখন কৃষকের হাতে নতুন ধান ওঠে এবং তাদের অর্থের প্রয়োজন থাকে, তখন পানির দরে বিপুল পরিমাণ ধান কিনে নিজেদের গুদামে মজুত করেছে। এখন যখন ধান কৃষকের হাত থেকে তাদের গুদামে চলে গেছে, তখন তারা ধীরে ধীরে চালের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে এবং নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অনৈতিক খেলায় কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আবার ভোক্তাকেও গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। লাভবান হচ্ছে শুধু মধ্যস্বত্বভোগী মজুতদারেরা।
এই পরিস্থিতি বারবার ফিরে আসার অন্যতম কারণ হলো সরকারের সংগ্রহ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতির দুর্বলতা। সরকার যদি মৌসুমের শুরুতেই সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে একটি যৌক্তিক মূল্যে বিপুল পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহ করত, তাহলে দুটি উদ্দেশ্য সফল হতো। প্রথমত, কৃষক তার ফসলের একটি ভালো দাম পেত, যা তাদের কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত করত। দ্বিতীয়ত, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুত থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পেত না। সরকার তার নিজস্ব মজুত থেকে খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার প্রতিবছর ধান-চাল কেনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, তা নানা কারণে পূরণ হয় না। এর পেছনে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের সম্ভাব্য আঁতাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই ব্যর্থতার কারণেই চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মুষ্টিমেয় কিছু মিলমালিক ও মজুতদারের হাতে।
এই মুহূর্তে হয়তো মিলমালিক ও আড়তদারদের গুদামে চলে যাওয়া চাল সরকারের পক্ষে ফেরত আনা সম্ভব নয়। কিন্তু বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের হাতে এখনো অনেক উপায় রয়েছে। সরকারের উচিত হবে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালের সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা। প্রয়োজনে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রির পরিমাণ ও পরিধি আরও বাড়াতে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় টিসিবি ও খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম দামে যে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। এসব বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে ক্রেতাদের দীর্ঘ সারিই প্রমাণ করে, গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ কতটা কষ্টে আছে।
যেকোনো উপায়ে হোক, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতেই হবে। সাধারণ মানুষের কষ্ট কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। যদি অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তবে সরকারের উচিত হবে কালক্ষেপণ না করে বিদেশ থেকে চাল আমদানি বাড়িয়ে অসাধু চক্রের কারসাজিকে ভেঙে দেওয়া। চাল কোনো সাধারণ পণ্য নয়, এটি দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গেও জড়িত। এই বাজার নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া উচিত নয়। সরকারের কঠোর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপই পারে সাধারণ মানুষকে এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।