
সত্যিই, এই পৃথিবীর শান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ কি আর অবশিষ্ট আছে? চারদিকে কেবল অস্থিরতা, অবিশ্বাস আর সংঘাতের বিষাক্ত বাতাস। দিন দিন মানুষ যেন তার সহজাত মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে, পরিণত হচ্ছে এক আত্মকেন্দ্রিক ও অসহনশীল জীবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা সত্যকে মুহূর্তেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু তার বদলে আমরা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার এক অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালগুলো পরিণত হয়েছে ঘৃণা আর বিভেদ ছড়ানোর রণক্ষেত্রে। অন্যের সাফল্য বা উন্নতিকে সহজে মেনে নেওয়ার মানসিকতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। একে অপরকে নিচে নামানোর এক অসুস্থ খেলাই যেন আমাদের একমাত্র বিনোদন। এই ব্যক্তিগত অসহনশীলতাই যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রূপ নেয়, তখন তা আজকের এই ভয়াবহ বৈশ্বিক সংকটের জন্ম দেয়।
এই অস্থিরতারই করুণ প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বজুড়ে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগুন নিভতে না নিভতেই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের অন্তহীন সংঘাত। সেই সংঘাতে একে একে জড়িয়ে পড়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। এখন আবার ইরান ও ইসরায়েল সরাসরি এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত, যেখানে কেউ কাউকে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে দুটি দেশের বা দুটি পক্ষের যুদ্ধ মনে হলেও, এর পেছনের চালিকাশক্তি ভিন্ন। মনে হচ্ছে, এই দেশগুলো যেন এক বিশাল দাবার বোর্ডের গুটি, যার কলকাঠি নাড়ছে পর্দার আড়ালে থাকা একেকটি পরাশক্তি। তারা নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য, অস্ত্রের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এই সংঘাতগুলোকে জিইয়ে রাখছে। তারা একজন আরেকজনের ওপর খবরদারি করতে একে অপরকে চোখ রাঙাচ্ছে, আর তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে অসহায় সাধারণ মানুষকে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা এখন আর শুধু সীমান্তের কাঁটাতারে সীমাবদ্ধ নেই। প্রযুক্তির দানবীয় শক্তির আস্ফালনে তা পৌঁছে গেছে প্রতিটি শহরের অলিতে-গলিতে, প্রতিটি ঘরে। শহরের আকাশে যখন সতর্কতামূলক সাইরেনের শব্দ বেজে ওঠে, তখন মানুষের মধ্যে শুরু হয় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি আর আশ্রয়ের জন্য বাঁচার আকুতি। এরপরই শুরু হয় ধ্বংসের সিম্ফনি। আকাশে উড়ে আসে ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিমান, ভূমিতে গর্জে ওঠে ট্যাংক আর কামান। নিচু দিয়ে উড়ে যায় অ্যাটাক হেলিকপ্টার, আর গভীর সমুদ্রে ওঁৎ পেতে থাকে সাবমেরিন। মানুষবিহীন ড্রোন আর আত্মঘাতী ড্রোন খুঁজে ফেরে তাদের লক্ষ্যবস্তু, আর ‘আয়রন ডোম’-এর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চেষ্টা করে এই হামলাগুলোকে আকাশে থাকতেই ধ্বংস করে দিতে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের তৈরি এই বিধ্বংসী যন্ত্রের কাছে মানুষই পরাজিত হয়। ভয়ঙ্কর বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এক একটি সভ্যতা, বড় বড় অট্টালিকা, স্কুল আর হাসপাতাল। যে হাসপাতালে একটু আগেও মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা চলছিল, সেই হাসপাতালই পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে করুণ মৃত্যু হয় কিছু অসহায় শিশু, নারী ও বৃদ্ধের। যে শিশুটি হয়তো একটু আগেই খেলনা হাতে দৌড়াচ্ছিল, তার কী অপরাধ ছিল? যে বৃদ্ধটি তার জীবনের শেষ দিনগুলো শান্তিতে কাটাতে চেয়েছিল, তার কী দোষ ছিল?
তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা তো শুধু শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। আরও করুণ মৃত্যু হয় সেই সব অবলা পশুপাখি আর কীটপতঙ্গের, যারা যুদ্ধ কী, কেন হয়, এর ভয়াবহতা কতটুকু—তার কিছুই জানে না। প্রকৃতির এই নিরীহ সৃষ্টিগুলোর দোষ কী? আসলে ক্ষমতার লড়াই আর একে অপরকে উপরে উঠতে না দেওয়ার যে অসুস্থ মানসিকতা, তার কাছে এই প্রশ্নগুলো অর্থহীন।
ছোটবেলায় বইয়ে পড়া সেই প্রশ্নটি আজ বারবার মনে পড়ে—বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? বিজ্ঞানের কল্যাণে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পায়ে হাঁটা মানুষ এখন গাড়িতে চড়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিচ্ছে। বিমানের মাধ্যমে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের এই রূপটি নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ।
কিন্তু এই বিজ্ঞানেরই আরেক রূপ কত ভয়ঙ্কর! এই বিজ্ঞানের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা, ফসফরাস বোমা, রাসায়নিক বোমা আর হাইড্রোজেন বোমার মতো সব বিধ্বংসী অস্ত্র। যে বিজ্ঞান মানুষকে বাঁচানোর জন্য ওষুধ তৈরি করে, সেই বিজ্ঞানই আবার রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করে গণহারে মানুষ হত্যা করার জন্য। যে প্রযুক্তি আমাদের বিশ্বকে একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত করেছে, সেই প্রযুক্তিই আবার সাইবার যুদ্ধের মাধ্যমে দেশগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই অস্ত্রগুলো এক নিমিষেই একটি মহাদেশ, এমনকি পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞানীরা যেমনটা বলেন, কোটি বছর আগে এক বিশাল উল্কাপিণ্ডের আঘাতে পৃথিবী থেকে ডাইনোসরের অধ্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ মানুষ নিজেই সেই ধ্বংসের কারণ হতে চলেছে।
খোদা না করুক, যদি কোনো কারণে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ লেগেই যায়, তাহলে কী হবে? পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ হয়তো তাৎক্ষণিকভাবেই মারা যাবে। আর বাকি মানুষ ও পশু-পাখিরা? তারা খাদ্যের অভাবে, তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট নানা রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে। পারমাণবিক শীতে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাবে, বছরের পর বছর সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাবে না। মানব সভ্যতা হয়তো হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যাবে, কিংবা সূচনা হবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো অধ্যায়ের, যেখানে আজকের এই অহংকারী মানুষের কোনো চিহ্ন থাকবে না।
তাহলে আমরা কোন পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছি? যেখানে সহনশীলতার বদলে ঘৃণা, সহযোগিতার বদলে সংঘাত আর ভালোবাসার বদলে বিভেদই প্রধান চালিকাশক্তি? এই পথ তো ধ্বংসের পথ। এই পথ থেকে আমাদের ফিরতেই হবে।
আসুন, আমরা এই সুন্দর পৃথিবীটাকে রক্ষা করি। যুদ্ধ, তা ছোট হোক বা বড়, তার মানেই হলো মানুষের ক্ষতি, প্রকৃতির ক্ষতি আর অসংখ্য প্রাণের বিনাশ। আসুন, আমরা সবাই মিলে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই গ্রহটাকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা করি। যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই। বন্ধ হোক এই ধ্বংসের খেলা। শান্তিময় হোক আমাদের এই পৃথিবী।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।