
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আজ এক গভীর সংকট বিরাজ করছে। এটি কেবল খাদ্য বা বাসস্থানের সংকট নয়, এটি আশার সংকট। নিজ ভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন যখন ফিকে হয়ে আসছে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার হাত ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে, তখন লাখো রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ এক অন্ধকার পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই সুযোগটিই লুফে নিচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি আমাদের সেই ভয়াবহ বাস্তবতার দিকেই আঙুল তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, হতাশ রোহিঙ্গারা কি তবে সশস্ত্র পথই বেছে নেবে?
ভেঙে পড়া স্বপ্নের পৃথিবী
কয়েক বছর আগেও পরিস্থিতি এতটা নাজুক ছিল না। ২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ আবেদনে রোহিঙ্গা তহবিলের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পূরণ হতো। প্রতি বছর প্রায় ৭০ কোটি ডলারের মানবিক সহায়তা তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অবলম্বনটুকু নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন মানবিক সংকট তৈরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে সরে গেছে। দাতাদের প্রতিশ্রুত তহবিল কমতে শুরু করেছে।
২০২৪ সালে এই সংকট আরও তীব্র হয়। তহবিলের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৫ শতাংশ পূরণ হয়। এর ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে আমেরিকার নীতি পরিবর্তন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিলে ব্যাপক কাটছাঁট করে। যেহেতু রোহিঙ্গা মানবিক কার্যক্রমের অর্ধেকের বেশি অর্থ আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে, তাই এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। শিবিরগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো জরুরি পরিষেবাগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বহু রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, যারা এনজিওগুলোতে কাজ করে সামান্য আয় করত, তারা চাকরি হারায়। ফলে আয়ের শেষ উৎসটুকুও বন্ধ হয়ে যায়। মার্চের শেষে কোনোমতে খাদ্য সহায়তাটুকু চালু রাখা সম্ভব হলেও, তা কেবল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। এরপর কী হবে, তা কেউ জানে না।
হতাশার গর্ভে জন্ম নিচ্ছে বিদ্রোহ
যখন একটি জনগোষ্ঠীর সামনে থেকে শিক্ষা, কাজ এবং ভবিষ্যতের সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন সেখানে অপরাধ এবং উগ্রবাদ জন্ম নিতে বাধ্য। আইসিজি-র প্রতিবেদনে এই কঠিন সত্যটিই উঠে এসেছে। পরিবার চালাতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অনেক রোহিঙ্গা তরুণ এখন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা অপরাধী চক্রে যোগ দিচ্ছে। একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর কথায় বিষয়টি স্পষ্ট: “শিবিরে অনেক তরুণই শিক্ষা বা কাজের মধ্যে নেই। যারা তাদের টাকা, ক্ষমতা ও সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা তাদের জন্যই কাজ করবে।” সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ঠিক এই সুযোগটিই নিচ্ছে। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে, তরুণদের উসকানিমূলক ভাষণ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে টানছে।
এর প্রভাব পড়ছে পুরো রোহিঙ্গা সমাজে। আর্থিক চাপে থাকা পরিবারগুলোতে হতাশা বাড়ছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং স্বামীদের দ্বারা স্ত্রীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। এমনকি, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাবে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে বন্দুক আর অপরাধ।
রাখাইনের নতুন বাস্তবতা ও সশস্ত্র পথের বিপদ
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে সীমান্তের ওপারে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। সেখানে এখন আরাকান আর্মির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। তারাই এখন রাখাইনের অলিখিত শাসক। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যদি কখনও হয়, তবে এই আরাকান আর্মির অধীনেই তাদের থাকতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে কিছু রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধেই একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছে। তারা শিবির থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আইসিজি-র প্রতিবেদন বলছে, এই পথটি আত্মঘাতী। আরাকান আর্মির সামরিক শক্তির সামনে এই রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো কিছুই নয়। তাদের এই বিদ্রোহ সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং এর পরিণতি হবে আরও বিপর্যয়কর। একটি নতুন যুদ্ধ শুরু হলে তা সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলবে এবং প্রত্যাবাসনের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেবে।
সমাধানের ক্ষীণ আলো
তবে সব আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আইসিজি তাদের প্রতিবেদনে সংকট সমাধানের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত পথের কথা বলেছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি বহুপাক্ষিক উদ্যোগ।
প্রথমত, বাংলাদেশ সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক নীতি চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ঢাকার উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া। এই আলোচনার মাধ্যমে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহের বদলে প্রণোদনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার রাখাইনের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য বাড়াতে পারে। অবরোধের কারণে রাখাইনে এখন নির্মাণসামগ্রী এবং কৃষি উপকরণের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এই বাণিজ্যে রোহিঙ্গাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি একদিকে রাখাইনের মানুষের কষ্ট কমাবে, অন্যদিকে রোহিঙ্গা এবং আরাকান আর্মির মধ্যে একটি সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করবে। এটি রোহিঙ্গাদের জন্য বৈধ আয়ের একটি পথও খুলে দেবে।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমেরিকার তহবিল কাটছাঁটের ঘাটতি পূরণ করা কঠিন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, তুরস্ক এবং উপসাগরীয় দেশগুলোকে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু জরুরি ত্রাণ নয়, রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার প্রকল্পেও বিনিয়োগ করতে হবে।
শিবিরগুলোতে ছোট ব্যবসা করার আইনি স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ এখন অবৈধভাবে শিবিরের বাইরে কৃষি বা নির্মাণের কাজ করে। তাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। এতে তারা অপরাধ জগৎ থেকে দূরে থাকবে। তাদের হাতে আইনিভাবে সিম কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা তুলে দিলে স্বচ্ছতা বাড়বে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
শেষ কথা
রোহিঙ্গা সংকট আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আন্তর্জাতিক অবহেলা ও তহবিলের অভাবে সৃষ্ট গভীর হতাশা, যা তাদের সশস্ত্র সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংলাপ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধানের ক্ষীণ সম্ভাবনা। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষা করবে না, বরং তাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে।
এখনই সময় সব পক্ষের এক হয়ে কাজ করার। বাংলাদেশ, আরাকান আর্মি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে যে, এই সংকটের আগুন যদি একবার জ্বলে ওঠে, তবে তা শুধু রোহিঙ্গা শিবিরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। সেই বিপর্যয় এড়ানোর সুযোগ এখনো আছে, কিন্তু সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।