বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ঋণ ছাড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অস্বস্তিতে আইএমএফ, দিলো একগুচ্ছ পরামর্শ

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ চার উদ্বেগের কথা বললেও ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি; যা ২৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জমা হবে।
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২৫ জুন ২০২৫ | ৭:৪৮ পূর্বাহ্ন


রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কঠোর মুদ্রানীতির প্রভাব, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এবং ব্যাংক খাতের চাপ—এই চার প্রধান কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো নাজুক অবস্থায় আছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে চলমান সংস্কার কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করে সংস্থাটি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির প্রায় ১৩৭ কোটি ডলার একসঙ্গে ছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে।

সোমবার রাতে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের হিসাবে এই অর্থ আগামীকাল ২৬ জুন জমা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সামষ্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও আইএমএফ কর্মসূচির অধীনে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর অগ্রগতি ‘মোটামুটি সন্তোষজনক’ এবং সরকার প্রয়োজনীয় নীতি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সংস্থাটি জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া উদ্যোগে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে ফেরাতে সহায়তা করেছে।

বিশেষজ্ঞের চোখে আইএমএফের মূল্যায়ন

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আইএমএফের এই মূল্যায়নকে যৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যে আছে, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিনিয়োগে স্থবিরতাও কাটেনি। আইএমএফ অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তা ঠিকই আছে।”

জাহিদ হোসেনের মতে, আইএমএফ মূলত তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়ার সুপারিশ করেছে—কঠোর আর্থিক নীতি অব্যাহত রাখা, বিনিময় হারের নতুন ব্যবস্থাটি বজায় রাখা এবং রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে বাজেটের ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা।

প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কমবে মূল্যস্ফীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছু ইতিবাচক পূর্বাভাসও দিয়েছে আইএমএফ। তাদের মতে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৩.৮ শতাংশে নামতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ৫.৪ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বহুল আলোচিত মূল্যস্ফীতির চাপও আগামী দিনে কিছুটা কমবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৯ শতাংশ থাকতে পারে, তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা কমে গড়ে ৬.২ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

সংস্কারের একগুচ্ছ পরামর্শ

সামনের দিনে বাংলাদেশের করণীয় বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সম্প্রতি বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করা এবং বাজেটে কর রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে তারা।

আইএমএফের অন্যান্য সুপারিশগুলো হলো:

* ধাপে ধাপে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে একটি টেকসই পর্যায়ে আনা।
* সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
* আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সংস্কারের ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল প্রণয়ন।
* ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য নতুন আইন দ্রুত কার্যকর করা।

সংস্থাটি আরও বলেছে, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে রপ্তানি বৈচিত্র্য, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, সুশাসন জোরদার এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের মান উন্নয়নের মতো টেকসই কাঠামোগত সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে।

ঋণ কর্মসূচির প্রেক্ষাপট

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, টাকার অবমূল্যায়ন এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩-এ সংস্থাটি সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে।

এর আওতায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তিতে ৪৭.৬৩ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮.১ কোটি ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার পায় বাংলাদেশ।