
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিতরণ করা সন্দেহভাজন ও লুটপাটের ঋণের ভারে দেশের ব্যাংক খাত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। খেলাপি ঋণের বোঝা, বিশেষ করে আদায় অযোগ্য ‘মন্দ ঋণের’ সুনামিতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি ভেঙে পড়ছে। এর প্রভাবে প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন সংকট পৌঁছেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যা শুধু ব্যাংকগুলোকেই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ আমানতকারী, সৎ উদ্যোক্তা এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের ৮১ শতাংশেরও বেশি, অর্থাৎ ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৫ কোটি টাকাই হলো ‘মন্দ ঋণ’। এটি খেলাপি ঋণের সর্বশেষ ধাপ, যেখান থেকে টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
যেভাবে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে: একটি চক্রাকার প্রভাব
এই বিপুল পরিমাণ মন্দ ঋণ ব্যাংক খাতে এক ভয়ংকর চক্রাকার সংকট তৈরি করেছে।
প্রথম ধাক্কা (প্রভিশন সংকট): নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে প্রতিটি মন্দ ঋণের বিপরীতে তাদের মুনাফা থেকে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করে রাখতে হয়, যাকে ‘প্রভিশন’ বলা হয়। এটি করা হয় যাতে ভবিষ্যতে ওই ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক দেউলিয়া না হয়ে যায়। কিন্তু যেভাবে মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, ব্যাংকগুলোর মুনাফা সেভাবে বাড়ছে না। ফলে তারা চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। এর ফলে তৈরি হয়েছে এক বিশাল প্রভিশন ঘাটতি। গত বছরের মার্চে যেখানে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা, চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকার এক অচিন্তনীয় পরিমাণে।
দ্বিতীয় ধাক্কা (মূলধন সংকট): এই প্রভিশন ঘাটতির সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলোর মূলধনের ওপর। ব্যাংকগুলোকে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন (কমপক্ষে ১০ শতাংশ) সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে, কিন্তু আয় কম হওয়ায় তারা মুনাফা থেকে মূলধন শক্তিশালী করতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংক খাতের গড় মূলধন রাখার হার স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে, অর্থাৎ মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি একটি ভয়াবহ চিত্র, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তির চরম দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে।
সংকটের নেপথ্যে ‘ঋণ লুটপাট’
বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই সংকটের মূল কারণ হলো গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের লুটপাট। অভিযোগ রয়েছে, ঋণের নামে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে বের করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া সেই ঋণগুলো এতদিন কাগজে-কলমে ভালো দেখানো হলেও, এখন সেগুলো খেলাপি হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ নবায়নের মতো বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন সামনে আসছে।
সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব
ব্যাংক খাতের এই দুর্বলতার প্রভাব পড়ছে দেশের প্রতিটি মানুষের ওপর। মূলধন সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এর ফলে শিল্প ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যাংকগুলো তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের ব্যাংকগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ব্যবসায়িক খরচও বেড়ে যাচ্ছে, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। এছাড়া, ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা যেমন প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি সাধারণ আমানতকারীরাও পাচ্ছেন না আমানতের ওপর ভালো মুনাফা।
ভবিষ্যতের অশনিসংকেত
পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত মূলত বাণিজ্যিক ঋণগুলো খেলাপি হয়েছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণগুলো এখনো সেই হারে খেলাপি হওয়া শুরু হয়নি। কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের হাতেই প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যা পরিশোধ না করা হলে শিগগিরই খেলাপি হয়ে যাবে। এছাড়া, আরও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার ঠিক আগের ধাপে রয়েছে। এগুলো খেলাপি হলে ব্যাংক খাতের সংকট আরও গভীর হবে।
তবে আশার কথা হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতে লুটপাট বন্ধ হয়েছে এবং সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু অতীতে ঘটে যাওয়া ‘সাগরচুরি’র কারণে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাব এখন প্রকাশিত হচ্ছে, যা মানুষকে হতবাক করছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ একটি দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া হবে, যার জন্য প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।