
কল্পনা করুন, আপনি একটি ঝলমলে শপিং মলে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার চোখে পড়েছে অসাধারণ কারুকাজ করা একটি ভারতীয় শাড়ি। দামটা একটু বেশি হলেও এর আভিজাত্য আপনাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি হয়তো জানেন না, আপনার হাতে থাকা সেই শাড়িটি কোনো বৈধ পথে আসেনি। এটি এক নীরব সুনামির অংশ, যা প্রতি বছর বাংলাদেশের তীরে আছড়ে পড়ছে, আর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাজারো তাঁতির স্বপ্ন, শ্রমিকের মুখের গ্রাস আর দেশীয় শিল্পের ভবিষ্যৎ।
এটি কোনো গল্প বা অতিরঞ্জন নয়। এটি আমাদের অর্থনীতির এক নির্মম বাস্তবতা। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার শাড়ি ও পোশাক চোরাই পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ভাবা যায়! এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে শুল্ক হিসেবে জমা হওয়ার কথা ছিল, যা দিয়ে হয়তো নতুন স্কুল বা হাসপাতাল তৈরি হতো। কিন্তু তার বদলে এটি পুষ্ট করছে একদল অসাধু চোরাকারবারি আর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পকেট।
এই বিশাল চোরাচালানের নেটওয়ার্ক কোনো সাধারণ অপরাধচক্রের কাজ নয়। এটি একটি সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যার শিকড় সীমান্ত থেকে শুরু করে খোদ রাজধানী, বন্দর নগরী পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রক্রিয়াটি অনেকটা সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো। সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক অদৃশ্য আঁতাত গড়ে তুলেছে। রাতের অন্ধকারে বা দিনের আলোতে শুল্কের তোয়াক্কা না করে ট্রাকের পর ট্রাক ভারতীয় কাপড় বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই পণ্যগুলোকে বৈধতা দেওয়ার জন্য থাকে জাল কাগজপত্র।
এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এই বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা দেশে। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান হাতিয়ার হলো কুরিয়ার সার্ভিস। শত শত কার্টন শাড়ি-কাপড় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে যায় নামকরা সব শপিং মলের গুদামে, এমনকি চট্টগ্রামের অভিজাত মার্কেটগুলোতেও। একজন সাধারণ ক্রেতা হিসেবে আপনার পক্ষে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে, দেশের সেরা শপিং মল থেকে কেনা পণ্যটি আসলে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা। এভাবেই এক ভূতুড়ে করিডোর দিয়ে দিনে-দুপুরে আমাদের অর্থনীতিকে ফাঁকি দিয়ে চলেছে এই সিন্ডিকেট।
বাইরের শত্রু যখন ঘর ভাঙার চেষ্টা করে, তখন তা প্রতিহত করা যায়। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকেই যদি কেউ দরজা খুলে দেয়? আমাদের পোশাক শিল্পে ঠিক তেমনটাই ঘটছে ‘বন্ড সুবিধা’র আড়ালে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পকে সহায়তা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুল্কমুক্ত সুতা ও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়ে থাকে। এই সুবিধার মূল উদ্দেশ্য হলো, দেশীয় উদ্যোক্তারা যেন কম খরচে পণ্য উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
কিন্তু হায়! এই মহৎ উদ্দেশ্যটিও একদল অসাধু চক্রের হাতে পড়ে দুর্নীতির এক ভয়ংকর মায়াজালে পরিণত হয়েছে। আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই বন্ড সুবিধাকে ব্যবহার করে দেশের সর্বনাশ করে চলেছে। নিয়ম অনুযায়ী, বন্ড সুবিধায় আনা শুল্কমুক্ত সুতা সরাসরি রপ্তানিমুখী কারখানার গুদামে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। বন্দর থেকে বের হওয়ার পথেই ট্রাক থেকে হাজার হাজার কেজি সুতা গায়েব হয়ে যায়। সেই সুতা খোলাবাজারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে স্থানীয় কাপড় উৎপাদনকারী কারখানায়।
এর ফলে যা ঘটছে তা এক কথায় ভয়াবহ। একজন সৎ দেশীয় উদ্যোক্তা যখন শুল্ক দিয়ে, ভ্যাট দিয়ে সুতা কিনে কাপড় তৈরি করছেন, তখন তার উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেশি পড়ছে। অন্যদিকে, চোরাই পথে আসা কাপড় বা বন্ডের কালোবাজারে বিক্রি হওয়া সুতা দিয়ে তৈরি পণ্যের দাম অনেক কম। এই অসম প্রতিযোগিতায় সৎ ব্যবসায়ীরা টিকতে পারছেন না। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে গুনতে তারা বাধ্য হচ্ছেন তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে। একসময় যে কারখানায় শত শত শ্রমিকের কোলাহলে মুখর থাকত, আজ সেখানে ঝুলছে তালা, নিভে গেছে তাঁতের শব্দ।
সবচেয়ে হতাশাজনক এবং উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বিশাল অপরাধযজ্ঞ যেন দেখার কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে এই অবৈধ সুতা বা কাপড়ের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে না। তাদের এই নীরবতা কি নিছকই অদক্ষতা, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্ন আজ দেশীয় শিল্প মালিকদের মুখে মুখে। কর্তৃপক্ষের এই ‘চোখ বুজে থাকা’ নীতি চোরাকারবারি এবং দুর্নীতিবাজদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। তারা ধরেই নিয়েছে, তাদের সাত খুন মাফ।
এই চোরাচালান কেবল দেশীয় শিল্পকেই ধ্বংস করছে না, এটি আমাদের অর্থনীতিকে আরও নানামুখী সংকটে ফেলছে। ৫৪ হাজার কোটি টাকার চোরাই পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। হুন্ডির এই চক্র মুদ্রাবাজারকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি অর্থ পাচার এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকেও উৎসাহিত করছে।
সরকার একদিকে দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে নানা প্রণোদনা দিচ্ছে, অন্যদিকে চোরাচালান আর বন্ড দুর্নীতির দুটি বিশাল রক্তচোষা জোক আমাদের শিল্পের রক্ত শুষে চলেছে। এই স্ববিরোধিতা চলতে থাকলে আমাদের বস্ত্রশিল্পের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আজ হয়তো ছোট ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে, কিন্তু এই নীরব সুনামি যদি থামানো না যায়, তাহলে অচিরেই বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও এর শিকার হবে।
তৈরি পোশাক খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নতুন নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এই খাতটিকে টিকে থাকতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, দেশের ভেতরের এই বিষফোঁড়াগুলো যদি এখনই অপসারণ করা না হয়, তাহলে সব অর্জন ধ্বংস হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
এখনই সময়, এই সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে একটি ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ পরিচালনা করার। কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা, বন্ড কমিশনারেট এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিতভাবে একটি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। যে সকল কর্মকর্তা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের বস্ত্রশিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠার আগেই আমাদের জাগতে হবে। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।