সোমবার (২১ জুলাই) দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে এক অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়ে গেল। রাজধানীর উত্তরায় একটি স্কুলের ওপর বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ভেঙে পড়ার ঘটনাটি নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক নির্মম দলিল। এ পর্যন্ত যে ৩২টি প্রাণ ঝরে গেছে, তার অধিকাংশই শিশু—ছোট ছোট স্বপ্ন, অপূর্ণ সম্ভাবনা আর একরাশ হাসির চিরকালীন প্রস্থান। এই ঢাকা শহর, এই দেশ একসঙ্গে এত শিশুর কফিন কাঁধে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই ক্ষত কোনোদিন শুকাবে না, এই ক্ষতি কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবে না।
পুরো দেশ আজ শোকে স্তব্ধ। রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন হয়েছে, পতাকা অর্ধনমিত হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, এই আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে রাষ্ট্র কি তার নিজের ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত? এই ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বড় কোনো বিপর্যয় সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর এবং সমন্বয়হীন।
ঘটনার পরমুহূর্তে আমরা যে দৃশ্য দেখেছি, তা আমাদের আশাবাদী করে। সাধারণ মানুষ, তরুণ-তরুণীরা যেভাবে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যেভাবে হাসপাতালের করিডোরে রক্ত দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে, তা এই জাতির মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই স্বতঃস্ফূর্ততাই আমাদের সমাজের মূল শক্তি। কিন্তু এই উজ্জ্বল মানবিকতার ঠিক উল্টো পিঠেই আমরা দেখলাম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কদর্য, সমন্বয়হীন ও অদক্ষ চেহারা। যখন প্রয়োজন ছিল দ্রুত, সমন্বিত এবং সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের, তখন আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো দেখাল চরম গড়িমসি আর ব্যর্থতার নজির।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যে মুহূর্তে আহত শিশুদের আর্তনাদ আর স্বজনদের কান্নায় হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, তখন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা আমরা প্রথম দিনে দেখতে পাইনি। তার এই অনুপস্থিতি কেবল সমালোচনার জন্ম দেয়নি, বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে, শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিব চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মতো একটি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মাঝরাত পার করে দিলেন। তাদের এই অদূরদর্শিতা হাজার হাজার পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছিল, যার জেরে শিক্ষাসচিবকে প্রত্যাহার পর্যন্ত করতে হয়েছে। এটি কি প্রমাণ করে না যে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সংকটের গভীরতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ?
প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দিয়ে আবার তা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি ছিল বিভ্রান্তিকর এবং সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এই দ্বিধাগ্রস্ততা এবং পরিকল্পনাহীনতাই জনমনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অবিশ্বাস জন্ম দিয়েছে।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অধ্যায় হলো, শোকে বিহ্বল, ট্রমাগ্রস্ত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর হামলা ও হেনস্তার ঘটনা। যে শিশুরা চোখের সামনে তাদের সহপাঠীদের পুড়ে মরতে দেখেছে, তাদের যন্ত্রণা বোঝার মতো সংবেদনশীলতাও কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? তাদের ছয় দফা দাবির বিক্ষোভ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ছিল না, ছিল তাদের জমে থাকা কষ্ট, ক্ষোভ আর নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। আইন উপদেষ্টা তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরও যে তারা শান্ত হয়নি, তার কারণ ব্যবস্থাপনার প্রতি তাদের গভীর অনাস্থা।
আমরা প্রায়শই প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই। কিন্তু যে প্রশ্নটি আজ প্রতিটি বিবেকবান নাগরিককে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তা হলো—কেন একটি জনাকীর্ণ মেগাসিটির বুকের ওপর দিয়ে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ চলতে হবে? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অব্যবহৃত এয়ারফিল্ডগুলো পড়ে থাকতেও কেন বারবার ঢাকাকেই বেছে নেওয়া হয়? এই একটি প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের নীতিনির্ধারকদের নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদাসীনতার চিত্র।
এই শোকের মুহূর্তেও রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ আমাদের হতাশ করেছে। অগ্নিদগ্ধ রোগীরা যখন সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন, তখন হাসপাতালে দলবল নিয়ে তাদের দেখতে যাওয়াটা সহানুভূতির প্রকাশ নয়, বরং শোককে পুঁজি করে এক নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রদর্শন। এই অমানবিক ‘ফটোসেশন’ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
সরকার আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসার নির্দেশনা দিয়েছে, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনার কথাও বলেছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল। শুধু একটি সরকারি নির্দেশনাই তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
তাই আমরা জোর দাবি জানাই, এই দুর্ঘটনায় আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্থায়ী ‘ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হোক। কোনো টাকাই একটি সন্তানের জীবনের বিকল্প হতে পারে না, কিন্তু এটি নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি।
পাশাপাশি, মাইলস্টোন স্কুলের যে হাজারো শিক্ষার্থী এক ভয়ংকর মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদের মনোজগৎ থেকে এই ক্ষতের দাগ মুছে ফেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব।
আজ শুধু চোখের জলে এই শোক প্রকাশের দিন নয়। এই ৩২টি নিষ্পাপ প্রাণের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়। এই ট্র্যাজেডিকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরের ব্যর্থতা চিহ্নিত করার এবং তা সংশোধনের একটি সূচনাবিন্দু হিসেবে নিতে হবে।
এই শিশুদের রক্তস্নাত আকাশ আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে—রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ? এই প্রশ্নের সৎ উত্তর খোঁজার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের নিরাপদ বাংলাদেশ।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।