
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তৈরি পোশাক শিল্প আজ এক অশনিসংকেতের মুখোমুখি। নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের মোট শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০ শতাংশে। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং দেশের প্রধান রপ্তানি খাতের অস্তিত্বের ওপর এক বিরাট আঘাত। যখন প্রতিযোগী দেশগুলো কম শুল্কে ব্যবসা করছে, তখন এই বিপুল বোঝা নিয়ে আমাদের শিল্প কতটা পথ চলতে পারবে, সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে সংকটের গভীরতা আরও স্পষ্ট হয়। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের কথায়, “আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম, এই ট্যারিফ হার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে।” আগে যেখানে আমাদের পণ্য গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করত, এখন সেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা চাপানো হচ্ছে।
বিজিএমইএ-র তথ্যমতে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। নতুন শুল্কহারে শুধু কর বাবদই গুনতে হবে ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি। এই বিপুল অর্থ দিয়ে ভিয়েতনাম বা ভারতের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
একটি তুলনামূলক চিত্র বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একটি কটন শার্ট উৎপাদনে আমাদের খরচ কম হলেও, শুধুমাত্র শুল্কের কারণে মার্কিন বাজারে আমাদের পণ্যের দাম ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি হবে, যাদের শুল্কহার মাত্র ২০ শতাংশ। আমদানিকারকরা কেন বাড়তি অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনবেন, যখন তাদের সামনে সস্তার বিকল্প খোলা রয়েছে? স্বাভাবিকভাবেই তারা বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকবে, যার প্রথম শিকার হবে আমাদের পোশাক শিল্প।
যদিও এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের এই ঘোষণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে বা স্থগিত রাখছে। অনেক ক্রেতা আবার এই বাড়তি শুল্কের বোঝা আমাদের কারখানাগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
এই সংকট শুধু পোশাক কারখানার মালিকদের নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন, ব্যাংকিং, বীমা, পরিবহনসহ পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন) একযোগে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রতিটি কারখানা বন্ধ হওয়ার অর্থ শুধু উৎপাদন থেমে যাওয়া নয়, হাজার হাজার পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া।
এই সংকটময় মুহূর্তে একে অপরকে দোষারোপের প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এ বিষয়ে বিজনেস কনসালটেন্ট আযীম মোহাম্মদের পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আযীম মোহাম্মদ তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, “এই blame game (দোষারোপের খেলা) দিয়ে কি কোনো কারখানা টিকে যাবে? কোনো শ্রমিকের বেতন নিশ্চিত হবে? সত্য হলো, আমরা সবাই একই নৌকায় আছি। সংকটের মুহূর্তে একে অপরকে দোষারোপ না করে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া জরুরি।” তিনি সবাইকে একজোট হয়ে পরিকল্পনা করার এবং আজকের সংকটকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাঁর এই বক্তব্যটিই এখন আমাদের মূল মন্ত্র হওয়া উচিত। সরকার, বিজিএমইএ, ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞরা—সবাইকে এক টেবিলে বসে এই জাতীয় সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করতে হবে।
যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং আগামী ১ আগস্টের মধ্যে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আশা করা হচ্ছে, শুধু কূটনৈতিক আলোচনার ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের একটি বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এখনই মাঠে নামতে হবে।
এই সংকট থেকে কার্যকরভাবে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হিসেবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একক নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি পণ্যের বৈচিত্র্য আনাও অপরিহার্য; সাধারণ পোশাকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ-মূল্যের ও ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য, যেমন—ম্যান-মেইড ফাইবার বা প্রযুক্তি-নির্ভর পোশাক উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে।
একইসাথে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ও সময় কমিয়ে এনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি, পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি, যার জন্য শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনার প্রতিটি ধাপে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে এবং দেশের মানুষকে এ বিষয়ে অবগত রাখতে হবে।
দিন শেষে, এই শুল্কের বোঝা যদি সত্যিই আমাদের কাঁধে চাপে, তবে বহু কারখানা বন্ধের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারস্পরিক দোষারোপের পথ পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, সময়োপযোগী কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাই পারে আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করতে। এখন দেখার বিষয়, আমরা সংকটকে সুযোগে পরিণত করতে পারি কি না।