বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী খুঁজতে হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রে!

ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
এস এম আক্কাছ | প্রকাশিতঃ ২৭ জুলাই ২০২৫ | ৯:০১ অপরাহ্ন


চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ যেন এক অদ্ভুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কাগজে-কলমে ৫২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও নিয়মিত ক্লাসে আসে মাত্র ২ থেকে ৪ জন। গত পাঁচ দিন তো শিক্ষক-শিক্ষার্থী শূন্য ছিল এই প্রতিষ্ঠান। কর্তৃপক্ষের দাবি, চলমান এইচএসসি পরীক্ষার কারণে কলেজ শাখা কার্যত বন্ধই ছিল। এভাবেই খুঁড়িয়ে চলছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখার কার্যক্রম।

এলাকার বাসিন্দা, অভিভাবক ও সচেতন মহলের শঙ্কা, রাজনৈতিক তদবিরে পাওয়া কলেজ শাখার পাঠদানের অনুমতি সহসাই বাতিল হতে পারে। রোববার (২৭ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এমন হতাশাজনক চিত্র।

পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, কলেজে কাগজে-কলমে তিন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও উপস্থিত আছেন মাত্র একজন। একটি শ্রেণিকক্ষে বসে আছে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী, দুজনেই ছাত্রী। কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, বৃষ্টি এবং এইচএসসি পরীক্ষা চলায় শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। বিদ্যালয় শাখায় পাঠদান চললেও দোতলায় কলেজ শাখার তিনটি শ্রেণিকক্ষের দুটিই ফাঁকা, পুরো ফ্লোরজুড়ে যেন এক সুনসান নীরবতা।

বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ২০ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত কলেজ শাখার কোনো বিভাগেই কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন না। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন চিত্র এলাকাবাসীকে দারুণ ভাবিয়ে তুলেছে।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখায় পাঠদান করছেন খণ্ডকালীন শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল রায়হান। কম শিক্ষার্থীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি আর এইচএসসি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থী কিছুটা কম।’ পাশের কক্ষটি কলেজ শিক্ষকদের মিলনায়তন, যেখানে টেবিলে এলোমেলো পড়ে আছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের হাজিরা খাতাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। তবে এই সময় একজন শিক্ষক ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। দুপুর পৌনে ১২টায় আসেন খণ্ডকালীন শিক্ষক সায়েম উদ্দিন চৌধুরী। তখনও অনুপস্থিত ছিলেন শিক্ষক মঞ্জুর ইসলাম।

প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনাম ও সাফল্যের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য এবং শিক্ষার গুণগত মান ছড়িয়ে দিতে ফটিকছড়ি সরকারি কলেজ থেকে সোয়া দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়টিকে ২০১৮ সালে ৪০ জন শিক্ষার্থী ও ৮ জন শিক্ষক নিয়ে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। পরে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পাঠদানের অনুমতি পায় কলেজটি। সে বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ফল ভালো হলেও এরপর থেকে ফলাফলে একটানা বিপর্যয় ঘটে।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষায় ৪৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানের এমন বেহাল দশা দেখে এলাকার বাসিন্দা, অভিভাবক ও সচেতন মহল আশঙ্কা করছেন যে, রাজনৈতিক তদবিরে পাওয়া কলেজ শাখার পাঠদানের অনুমতি বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে কলেজের কার্যক্রমকে গতিশীল করারও সুপারিশ করেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আমাদের গর্বের। এটি এভাবে চলতে পারে না। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথর্ব-অযোগ্যদের কবল থেকে প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা পাবে।’

সাংবাদিক সালাউদ্দিন জিকু বলেন, ‘কলেজ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন দরকার। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে আমরা শিক্ষার গুণগত মান হারাতে পারি না। এখন প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে কলেজের কার্যক্রম তরান্বিত হোক।’

প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুনব বড়ুয়া তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চরম অনীহা দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অপারগতার বিষয়টি অনেকবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে জানিয়েছি। তিনি অত্র কলেজ কমিটির সভাপতি। কিন্তু আর্থিক দৈন্যতার কারণে কলেজ শাখায় নতুন শিক্ষক নেওয়া যাচ্ছে না, তেমনি ভবিষ্যতেও কোনো উন্নতি করা যাচ্ছে না। আমি প্রাণের এই প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখাটিকে সাজানোর চেষ্টা করছি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এডহক কমিটির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আর্থিক দৈন্যতার কারণে ইতিমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বেতনের তিন শিক্ষকের ছয় মাসের বেতন বকেয়া। মানসম্মত শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কলেজ শাখাটিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’