
আমাদের যাপিত জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে কত না দর্শন! সাধারণ বিষয় থেকেও যে অসাধারণ উপলব্ধি হতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় রান্নাঘরের নুন আর চিনি। কবি জয় গোস্বামীর লাইনগুলো দিয়েই শুরু করা যাক—
“আমরা তো অল্পে খুশি! কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাত-কাপড়ে!!”
এই ‘অল্পে খুশি’ থাকার মন্ত্র যেন সবচেয়ে বেশি ধারণ করে আছে নুন। আমাদের বিশাল জীবনে তার প্রয়োজন কতটুকুই বা? এক চিমটি, কিংবা এক চামচ। অথচ এই সামান্য বস্তুটি ছাড়া জীবনের স্বাদই যে বিস্বাদ!
ভাবুন তো, পৃথিবীর তিন ভাগ জল লবণাক্ত, অর্থাৎ নুনে পরিপূর্ণ। কিন্তু সেই সাগর থেকে সরাসরি এক দানা নুন তুলে মুখে দেওয়ার জো নেই। এই সহজলভ্য জিনিসটাকে খাবার উপযোগী করতে যে শ্রম আর পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তা রীতিমতো মহাযজ্ঞ। জোয়ারের পানি আটকে রেখে তাকে রোদে শুকিয়ে, চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় আমাদের খাবারের সঙ্গী—লবণ। খনিতেও মেলে তার সন্ধান।
এর মাহাত্ম্য বোঝাতে একটি প্রাচীন গল্পই যথেষ্ট। রাজা তার তিন কন্যাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে তাকে কেমন ভালোবাসে। দুই কন্যা যখন মধু আর চিনির মতো মিষ্টি ভালোবাসার কথা বললো, ছোট কন্যা অকপটে বলেছিল, “বাবার প্রতি আমার ভালোবাসা নুনের মতো।” রাজা রেগে গেলেও পরে ঠিকই বুঝেছিলেন, নুন ছাড়া যেমন রাজভোগও মুখে তোলা যায় না, তেমনি অকৃত্রিম ভালোবাসা ছাড়া জীবনটাই অর্থহীন।
আপনি হাজার মানুষের জন্য দশ মণ মাংস রান্না করুন বা সেরা সবজিই আনুন, লবণ লাগবে বড়জোর দশ কেজি। এর এক বিন্দু বেশি হলেই সব আয়োজন মাঠে মারা যাবে। আবার এক বিন্দু কম হলেও সেই খাবারের কোনো স্বাদ থাকবে না। এখানেই নুনের কারিশমা। সে পরিমাণে অল্প, কিন্তু অপরিহার্য।
এর সবচেয়ে বড় দর্শন হলো, “ইতিহাস সাক্ষী, নুনে কখনো পোকা ধরে না।”
ঠিক তেমনি, যে মানুষটি আপনাকে নুনের মতো তেতো সত্য কথা বলে, সে-ই আপনার প্রকৃত বন্ধু। তার কথায় সাময়িক কষ্ট হতে পারে, রাগ হতে পারে, কিন্তু দিনশেষে সে আপনার ক্ষতি করবে না। তবে আফসোসের বিষয়, এই তেতো সত্যের কদর সমাজে কম। মানুষ মিষ্টি কথা শুনতে ভালোবাসে, তেতো কথায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এবার আসা যাক চিনির প্রসঙ্গে। আখ নিংড়ে তার মিষ্টি রস থেকে তৈরি হয় চিনি আর গুড়। এর আবেদন মারাত্মক। মিষ্টি, চকলেট, আইসক্রিম, কোমল পানীয়—চিনির তৈরি লোভনীয় খাবারের তালিকা শেষ হওয়ার নয়। শিশুরা তো বটেই, বড়রাও এর মায়াজালে আচ্ছন্ন।
কিন্তু এই মিষ্টির পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ। অতিরিক্ত চিনি মানেই শরীরে রোগের আমন্ত্রণ। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, এমনকি ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, যারা বেশি চিনি খান, তাদের বয়সের আগেই বার্ধক্যের ছাপ পড়ে যায়। শিশুদের দাঁতের ক্ষয় থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যেও এর বাজে প্রভাব রয়েছে। তাই চিনির ব্যবহার কমানোই শ্রেয়।
এই চিনির দর্শনটিও আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা চিনির মতো মিষ্টি ভাষায় কথা বলে, মন গলিয়ে দেয়, তাদের বন্ধুত্ব সবাই চায়। তাদের কথায় বাহবা জোটে, গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু এই মিষ্টি কথার আড়ালেই অনেক সময় লুকিয়ে থাকে গভীর রহস্য আর স্বার্থপরতার জাল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বড় বড় বিশ্বাসঘাতকতা কাছের ‘মিষ্টি’ মানুষের হাত ধরেই হয়েছে।
জীবন চলার পথে আমাদের সঙ্গে নুনের মতো তেতো আর চিনির মতো মিষ্টি—দুই ধরনের মানুষেরই সাক্ষাৎ হয়। একজন আপনার ভুল ধরিয়ে দিয়ে আপনাকে শুধরে দিতে চায়, অন্যজন মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখে আপনাকে হয়তো ভুল পথেই পরিচালিত করে।
মনে রাখবেন, তেতো হলেও নুন কখনো পচে না, পোকা ধরে না। তার আবেদন চিরন্তন। অন্যদিকে, মিষ্টিতে পিঁপড়া ধরে, বেশি হলে তা শরীর ও জীবনের জন্য বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
এখন কাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নেবেন, কার কথায় আস্থা রাখবেন, সেই ভালো-মন্দ বোঝার দায়িত্ব আপনার এবং আমার। আসুন, আমরা নুনের মতো খাঁটি এবং চিনির মতো মিষ্টির ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে শিখি। সকলের জীবন শান্তিময় হোক, মানুষের অন্তরে কেবলই ভালোবাসা আর মানবতার জয় হোক।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।