বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

চট্টগ্রামে প্রতি দুই বাড়ির একটি মশার আঁতুড়ঘর: দায় নেবে কে?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ৩০ জুলাই ২০২৫ | ৭:৫০ পূর্বাহ্ন

Dengue
চট্টগ্রাম নগরীর অলিতে-গলিতে এখন এক অদৃশ্য আতঙ্ক। দিনের আলো ফোটার সাথে সাথেই শুরু হয় ভয়, আর রাত নামলে তা রূপ নেয় বিভীষিকায়। এই আতঙ্কের নাম এডিস মশা। ঘরে ঘরে যে যন্ত্রণা আজ কান্নার রোল তুলেছে, তার নাম চিকুনগুনিয়া। সাথে আছে ডেঙ্গুর প্রাণঘাতী ছোবল।

চট্টগ্রাম আজ এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি। এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; বরং সমন্বিত উদ্যোগের অভাব, পরিকল্পনার ব্যর্থতা এবং দূরদর্শীহীনতার এক করুণ পরিণতি। যে মশা খালি চোখে দেখা যায়, যে শত্রুকে আমরা চিনি, তার কাছে একটি পুরো মহানগরী যেন অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা মনে করি, এই সংকট কেবল কয়েকটি পরিসংখ্যানের যোগফল নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক লজ্জাজনক দলিল।

কাগজে-কলমে যে সংখ্যাগুলো উঠে আসছে, তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, রীতিমতো আতঙ্ক ধরানোর মতো। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদন চট্টগ্রামকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু এই ঝুঁকির গভীরতা বোঝা যায় গত বছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়েছে।

২০২৪ সালে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জরিপে যেখানে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, সেখানে চলতি বছর আইইডিসিআরের গবেষণায় তা ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ২০ শতাংশের বেশি হলেই পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়। তাহলে ৭৫ শতাংশকে আমরা কী বলে অভিহিত করব? এ কি শুধুই ঝুঁকি, নাকি রীতিমতো মহাবিপদ সংকেত?

এই পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মশা নিধনে আমাদের উদ্যোগগুলো কতটা অন্তঃসারশূন্য। শুধু রাস্তাতেই নয়, আমাদের ঘরও এখন নিরাপদ নয়। গত বছর যেখানে ৩৭ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশে। অর্থাৎ, প্রতি দুটি বাড়ির একটি এখন মশার প্রজননক্ষেত্র।

এই সংখ্যাতত্ত্বের নির্মম বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালগুলোতে। চলতি বছর ৭৯৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন আটজন, যার মধ্যে ছয়জনেরই মৃত্যু হয়েছে এই জুলাই মাসে। এর চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকুনগুনিয়া। ৭৬৪ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—উভয় রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

যখন একটি শহর এভাবে রোগের কাছে পর্যুদস্ত হয়, তখন নগরবাসীর চোখ থাকে কর্তৃপক্ষের দিকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং সিভিল সার্জন কার্যালয় কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে? সিভিল সার্জন বলছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে এবং ‘কাজ চলছে’। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা দাবি করছেন, তারা ‘ক্রাশ কর্মসূচি’ চালাচ্ছেন এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ‘চলমান’ কাজ বা ‘ক্রাশ কর্মসূচি’র ফলাফল কী? ফলাফল তো আমরা পরিসংখ্যানেই দেখতে পাচ্ছি—লার্ভার ঘনত্ব দ্বিগুণ, রোগীর সংখ্যা আকাশচুম্বী। যেখানে মশার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের প্রায় চার গুণ বেশি, সেখানে এমন গতানুগতিক, মৌসুমি কর্মসূচির ওপর নির্ভর করাটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।

মশা মারার জন্য যে ওষুধ ছিটানো হয়, তার কার্যকারিতা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। মশা কি আদৌ মরে, নাকি শুধু উড়ে যায়? এই প্রশ্ন এখন চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে। সমন্বিত উদ্যোগের অভাব এখানে স্পষ্ট। সিভিল সার্জন কার্যালয় জরিপ করে, সিটি করপোরেশন মশা মারে, জেলা প্রশাসন সমন্বয় করে—এই তিন সংস্থার কাজের দৃশ্যমান ও কার্যকর প্রতিফলন কোথায়?

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির দায় কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর দায় আমাদের সকলের। তবে মূল দায়িত্বটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখা এবং পরিকল্পিতভাবে মশা নিধন তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। এই দায়িত্ব পালনে বছরের পর বছর ধরে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, আজকের সংকট তারই পুঞ্জীভূত ফল।

এখন প্রয়োজন জরুরি এবং সমন্বিত পদক্ষেপ। সমাধানের পথগুলো আমাদের অজানা নয়:

১. বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ: শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়, বছরজুড়েই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত লার্ভা ধ্বংস এবং উড়ন্ত মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. শক্তিশালী মনিটরিং ও জবাবদিহিতা: মশা নিধন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন ওষুধ, কী পরিমাণে, কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কার্যকারিতা কতটুকু—এসবের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৩. নাগরিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ: মশা নিধন কেবল সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। এডিস মশার জন্ম হয় ঘরে বা এর আশেপাশে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে। ফুলের টব, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি—এগুলোই মশার আঁতুড়ঘর। প্রতিটি নাগরিককে নিজের ঘর ও আঙিনা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। সিটি করপোরেশনকে ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে নাগরিকদের এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম আজ এক নীরব যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধের শত্রু ক্ষুদ্র হলেও তার প্রভাব মারাত্মক। কর্তৃপক্ষের আশ্বাস আর গতানুগতিক পদক্ষেপে আর একটি দিনও নষ্ট করার সুযোগ নেই। চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হলে এখনই জাগতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষকে তাদের দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিতে হবে, আর নগরবাসীকে হতে হবে সচেতন যোদ্ধা। অন্যথায়, এই অদৃশ্য শত্রুর কাছে আমাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।