
মাঝে মাঝে কিছু বিষয় মাথায় এলে অদ্ভুত এক ঘোর তৈরি হয়। আজকেও তেমনটাই হলো, তবে বিষয়বস্তুটা একেবারেই ব্যতিক্রম—গণিত! সত্যি বলতে, আমি কোনোদিনই গণিতে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। তাই গণিত নিয়ে গভীর আলোচনায় বসাটা আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু তাই বলে কি লেখা থেমে থাকবে? একদমই না!
লেখা শুরুর আগে একটি প্রশ্ন সবার জন্য—আমরা কি গণিত ছাড়া চলতে পারি? কেউ হয়তো বলবেন ‘হ্যাঁ’, আবার কারও উত্তর হবে ‘না’। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝি, গণিত ছাড়া পৃথিবী সত্যিই অচল। চলুন, এবার মূল আলোচনায় গভীরে ডুব দেওয়া যাক।
আমাদের জীবনের হিসাব কিন্তু শুরু হয় জন্মের আগে থেকেই। একটি শিশু তার মায়ের গর্ভে কতদিন ধরে আছে, আর কতদিন পরেই বা পৃথিবীর আলো দেখবে—এই যে আমরা স্বাভাবিকভাবে ‘দশ মাস দশ দিন’ বলি, এটাও তো গণিতেরই হিসাব! জন্মের পর কোন বয়সে টিকা দিতে হবে, কখন স্কুলে ভর্তি করা হবে, এমনকি কত বছর বয়সে চাকরির প্রস্তুতি নিতে হবে, সবকিছুই বাঁধা নির্দিষ্ট সংখ্যার জালে। চাকরি পাওয়ার পর কত বছর কাজ করতে পারবেন, সেই পরিকল্পনাও তো গণিতের ওপর নির্ভরশীল।
এবার ভাবুন তো আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির কথা। এটি কিন্তু স্থির নয়। নিজ অক্ষের ওপর ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরছে, যাকে আমরা আহ্নিক গতি বলি। এর ফলেই দিন এবং রাত হয়। আবার সূর্যের চারপাশে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে একবার ঘুরে আসে, যা তার বার্ষিক গতি। সময়ের এই হিসাব—৬০ সেকেন্ডে এক মিনিট, ৬০ মিনিটে এক ঘণ্টা, ২৪ ঘণ্টায় একদিন এবং ৩৬৫ দিনে এক বছর—সবই গণিতের সুতোয় বাঁধা। এমনকি প্রতি চার বছর পর যে একটি দিন বেড়ে গিয়ে লিপ ইয়ার হয়, সেটাও গণিতের এক চমৎকার হিসাব।
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে গণিত ছাড়া এক পা ফেলাও মুশকিল। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী আজ কতটুকু চাল, তেল, সবজি বা লবণ লাগবে, সেই হিসাব আমাদের রোজ করতে হয়। একজন মানুষ প্রতিদিন কত টাকা আয় করছেন, কত খরচ করছেন, আর মাস শেষে কত জমাচ্ছেন—এই সবকিছুই গাণিতিক হিসাব-নিকাশ।
ধরুন, আপনি অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। তিনি আপনার পালস, হার্টবিট, রক্তে সুগারের মাত্রা কিংবা কোলেস্টেরলের পরিমাণ মাপবেন। এই প্রতিটি পরিমাপই সংখ্যাভিত্তিক। আপনার ওজন ও উচ্চতা মেপে সঠিক মাত্রার ওষুধ নির্ধারণ করাটাও গণিতের এক জটিল সমীকরণ।
একটি বাড়ি বানাতে কী পরিমাণ ইট, বালি, সিমেন্ট বা লোহা লাগবে? বাড়িটি কত ফুট লম্বা বা চওড়া হবে? ঘরের জন্য কয়টি চেয়ার-টেবিল বা খাট তৈরি করতে কতটুকু কাঠ প্রয়োজন? এই সবকিছুর নির্ভুল হিসাব ছাড়া কি এক ধাপও এগোনো সম্ভব?
আবার ধরুন, ঢাকা বা কক্সবাজার বেড়াতে যাবেন। গাড়ির ভাড়া কত, গাড়ির গতি কেমন হবে, নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে কত গতিতে চলতে হবে, কিংবা বিমানে গেলে কত উচ্চতায়, কত গতিতে উড়তে হবে—এই সব পরিকল্পনার পেছনেও রয়েছে গণিতের অদৃশ্য হাত।
গণিতের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো এর সততা। ৪+৪=৮, এই সত্যকে কোনো পাগলও অস্বীকার করবে না। আবার ৫-৪=৩ বললে কেউই মানবে না। গণিত আমাদের সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখায়। এটি এক অর্থে সততার পাঠ দেয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি ১,০০০ টাকার চেকে একটি শূন্য বাড়িয়ে ১০,০০০ বানিয়ে ফেলে, তবে সেটা গণিতের অপব্যবহার, যা এক ধরনের প্রতারণা।
জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু করে জীবনের শেষযাত্রায় কবরের মাপ পর্যন্ত—প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা গণিতের গোলকধাঁধায় বাঁধা। মাটির কত গভীরে খনিজ সম্পদ লুকিয়ে আছে, তার সন্ধানও মেলে গাণিতিক হিসাবেই। তাই জোর গলায় বলাই যায়, গণিত ছাড়া পৃথিবী অচল!
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।