
স্রেফ একটি ধর্ষণের অভিযোগ। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির সবুজ পাহাড় এখন অগ্নিগর্ভ। অবরোধ, সহিংসতা, আর পাল্টা সংঘাতে গত কয়েকদিন ধরে পুরো জেলাজুড়ে বিরাজ করছে এক থমথমে পরিস্থিতি। একজন পাহাড়ি স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে যে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে, তা এখন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দিকে মোড় নিয়েছে। তবে ঘটনার গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে প্রশ্ন উঠছে—এটি কি কেবলই বিচারের দাবিতে আন্দোলন, নাকি এর আড়ালে রয়েছে পাহাড়কে অশান্ত করার কোনো গভীর ষড়যন্ত্র?
ঘটনার সূত্রপাত ও একটি প্রশ্নবিদ্ধ গ্রেপ্তার
ঘটনার শুরু গত ২৩ সেপ্টেম্বর। ওইদিন রাত ৯টার দিকে জেলা সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক মারমা ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে তিনজন মিলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। পরদিন ভোরে ভুক্তভোগীর বাবা খাগড়াছড়ি সদর থানায় অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
কিন্তু ঘটনার পর থেকেই কিছু বিষয় সন্দেহের জন্ম দেয়। অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনাটি রাত ৯টার। অথচ এর কিছুক্ষণ পরই স্থানীয় এক বাঙালি তরুণ, চয়ন শীলের ছবি দেখিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে পাহাড়ি যুবকদের একটি দল। চয়নকে না পেয়ে তার বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। পরিবার থেকে জানানো হয়, চয়ন রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে পড়াশোনা করেন এবং ঘটনার সময় সেখানেই ছিলেন। এরপর তার ছোট ভাই শয়ন শীলকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাকে পুলিশ ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার দেখায়।
তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিসিটিভি ফুটেজ
শয়ন শীলের গ্রেপ্তার এবং তাকে ঘিরেই আন্দোলন দানা বাঁধলেও কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ পুরো ঘটনাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। মামলার এজাহারে ধর্ষণের সময় রাত ৯টা উল্লেখ করা হলেও, হাতে আসা ফুটেজে দেখা যায়, শয়ন শীল সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৯টা ৫২ মিনিট পর্যন্ত খাগড়াছড়ি বাজারের বিভিন্ন দোকানে পূজার কেনাকাটা করছিলেন।
যদি ফুটেজটি সঠিক হয়, তাহলে একই সময়ে তার পক্ষে ঘটনাস্থলে থাকা প্রায় অসম্ভব। এই অসংগতি মামলার প্রাথমিক ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিয়েছে এবং প্রশ্ন তুলেছে, তাহলে কি শয়নকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে?
এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় দীঘিনালার শিশু কৃত্রিকা ত্রিপুরা হত্যাকাণ্ডের কথা। সেবারও বাঙালি যুবকদের দায়ী করে পাহাড় উত্তপ্ত করা হয়েছিল। কিন্তু পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তে বেরিয়ে আসে, ঘটনার সাথে সগোত্রীয়রাই জড়িত ছিল।
প্রতিবাদ থেকে সহিংস তাণ্ডব
শয়নের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আন্দোলনকারীরা কঠোর অবস্থানে যায়। দফায় দফায় সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পরিস্থিতি দ্রুতই সহিংসতার দিকে গড়ায়। শনিবার সকাল থেকে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কসহ জেলার বিভিন্ন সড়কে গাছ কেটে ও টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। পর্যটকদের হেনস্তা করা, অ্যাম্বুলেন্সে হামলা এবং এমনকি সেনাবাহিনীর টহল গাড়িতে আক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটে।
দুপুরের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজার, মহাজনপাড়া, নারিকেল বাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বেশ কিছু দোকানপাট। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন খাগড়াছড়ি পৌরসভা, সদর ও গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। নামানো হয় সাত প্লাটুন বিজিবি। কিন্তু এরপরও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলে, যাতে উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হন।
নেপথ্যের ইন্ধনদাতা কারা?
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এই বিক্ষোভের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। ধর্ষণের মতো একটি সংবেদনশীল ঘটনাকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে পাহাড়কে অশান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র। অভিযোগের তীর উঠেছে খাগড়াছড়ির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং সাবেক পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, তার ইন্ধনেই আন্দোলনকারীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
গোয়েন্দারা আরও মনে করছেন, এর পেছনে পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং একটি আন্তর্জাতিক চক্রেরও মদত রয়েছে। মূলত গত বছরের একটি সংঘাতের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে পুরো জেলাকে উত্তপ্ত করার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। এই বিক্ষোভ আয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
জনমনে আতঙ্ক, পর্যটকদের দুর্ভোগ
সহিংসতার জেরে খাগড়াছড়িতে এখন অঘোষিত অচলাবস্থা। সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। সবচেয়ে বড় দুর্ভোগে পড়েন সাজেকে আটকে পড়া প্রায় দুই হাজার পর্যটক। শনিবার রাতে সেনাবাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তায় তাদের খাগড়াছড়ি হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে পাঠানো হয়।
এদিকে, ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ চারটি দাবি উত্থাপন করে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিয়েছে। তাদের দাবিগুলো হলো—ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার, সমাবেশে হামলাকারীদের বিচার, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন।
বর্তমানে শহর শান্ত থাকলেও পরিস্থিতি থমথমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর টহলের মধ্যেও বাতাসে ভাসছে অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের গন্ধ। একটি ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে যে আগুন জ্বলছে, তার পেছনের ক্রীড়ানকদের খুঁজে বের করতে না পারলে এই অস্থিরতা যে আরও গভীর সংকটের জন্ম দেবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রকৃত সত্য উন্মোচিত না হলে এ আগুন আরও ছড়ানোর আশঙ্কা অমূলক নয়।