
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত কক্সবাজারের চকরিয়ার চিংড়ি জোনে এ বছর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়া, প্যারাবন নিধন এবং প্রভাবশালী চক্র কর্তৃক খাল দখলের কারণে চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নেমেছে। এতে হাজার হাজার ঘের মালিক ও চাষি তাদের বিনিয়োগের বড় অংশ হারিয়ে চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ এই মৎস্য ভান্ডারের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
চাষিরা জানান, চলতি মৌসুমে অনাবৃষ্টি ও তীব্র গরমের কারণে ঘেরের পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, ফলে চিংড়িতে কয়েক দফা মড়ক লাগে। এছাড়া, পলি জমে ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়া, পানি নিষ্কাশনের খালগুলো দখল হয়ে যাওয়া এবং প্যারাবন ধ্বংস করে ফেলায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মাছের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
উপজেলার অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি চাষি আবু তৈয়ব জানান, তিনি প্রায় এক হাজার একর জমিতে এক কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু মৌসুম শেষে মাছ বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৭০ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা। গত বছরও যেখানে তিনি কোটি টাকার বেশি লাভ করেছিলেন, এ বছর তাকে গুনতে হচ্ছে বড় অঙ্কের লোকসান।
একইভাবে সাহারবিলের চাষি নজরুল ইসলাম ২০০ একর জমিতে অন্য বছর ৩০-৪০ লাখ টাকা আয় করলেও এ বছর পেয়েছেন মাত্র ১০ লাখ টাকার মাছ, যার মধ্যে চিংড়ি ছিল মাত্র ২০০ কেজি। সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চাষি আজিজুল হাকিম জানান, একসময় যেখানে প্রতি হেক্টরে ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, এখন তা ২০০ কেজির নিচে নেমে এসেছে।

চাষি ও বিশেষজ্ঞরা এই বিপর্যয়ের জন্য একাধিক কারণকে দায়ী করছেন।
প্রকৃতির বৈরিতা: এ বছর বৃষ্টি কম ও গরম বেশি হওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, যা চিংড়ি মড়কের প্রধান কারণ।
খাল দখল ও প্যারাবন নিধন: পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের চাষি মাওলানা শহিদুল ইসলাম জানান, চিংড়ি ঘেরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় ১১টি খাল প্রভাবশালীরা দখল করে রাখায় জোয়ার-ভাটার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ঘেরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকছে না। এছাড়া প্যারাবন কেটে ঘের সম্প্রসারণ করায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টু বলেন, চিংড়ি জোনে চাঁদাবাজি ও ডাকাতের উপদ্রব চাষিদের জন্য আরেকটি বড় আতঙ্ক।
চাকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন উৎপাদনের এই ভয়াবহ ধসের কথা স্বীকার করে বলেন, “প্রকৃতির বৈরী আচরণ, খাল দখল, ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়া এবং পোনা সংকটের কারণে এ বছর উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমেছে।”
তবে তিনি আশার কথাও শুনিয়েছেন। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর রামপুর মৌজায় ৭২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ এবং ২৩টি আধুনিক স্লুইসগেট নির্মাণ করছে। পাশাপাশি, ঘেরের চারপাশে প্রায় তিন লক্ষ বাইন ও কেওড়া গাছ লাগিয়ে প্যারাবনও সৃজন করা হচ্ছে।
চাকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, চিংড়ি জোনের দুর্গমতার কারণে নিয়মিত টহল দেওয়া কঠিন হলেও তারা অপরাধ দমনে সজাগ রয়েছেন এবং টহল তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি খালগুলো দখলমুক্ত করা এবং কঠোরভাবে প্যারাবন নিধন বন্ধ করা না গেলে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।