আবু আজাদ : আমাদের চারপাশে ওঁৎ পেতে আছে ওরা। নানা ছদ্মবেশে। নানা কৌশলে। সুযোগ বুঝে ছোঁ মারছে। হামলে পড়ছে। মুহূর্তেই ছিনিয়ে নিচ্ছে সবকিছু। অভিনব সব কৌশল ছিনতাইকারীদের। রকমারি ফাঁদ পেতে বসে আছে তারা। প্রতিদিন ঘটছে ছিনতাইয়ের বিচিত্র ঘটনা।
এবার রাস্তায় পথচারী কিংবা রিকশাযাত্রী ছিনতাইয়ে এক অভিনব কৌশল এঁটেছে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকাজে ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশার কাভারে কাটা হচ্ছে বিশেষ ‘পকেট’। পথচারী কিংবা রিকশাযাত্রীর কাছাকাছি গিয়ে ওই পকেট দিয়ে বের করে দিচ্ছে হাত। সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে হাতে থাকা মোবাইল ফোন সেট, টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র।
গত বুধবার (১৪ মার্চ) দুপুরে নগরীর নুর আহম্মদ সড়কের নেভাল এভিনিউ এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করা এক লাখ ৭০ হাজার টাকা, অস্ত্র ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা (চট্টমেট্রো : থ ১১২৩৮৫) জব্দ করা করেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিএনজি অটোরিকশাটির ডান পাশের কাভারটি দুই জায়গায় কৌশলে কেটে রাখা হয়েছে। যা দিয়ে যে কেউ চাইলে বাইরে তার হাতটি বের করে দিতে পারে। টান দিতে পারে পথচারী কিংবা রিকশাযাত্রীর হাতের মূল্যবান জিনিসপত্র।
অভিযানে অংশ নেয়া নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা সাধারণত শক্তি প্রদর্শন করেই ছিনতাই করে। তবে কিছুদিন ধরে পথচারি বা রিকশাযাত্রীদের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে জিনিস নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে সিএনজির কাভার কেটে বানানো হয় পকেট। ওই পকেট দিয়ে হাত বের করে ছিনিয়ে নেওয়া হয় অন্যের হাতের জিনিসটি।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (গোয়েন্দা-বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ছিনতাইয়ের যেমন নানা কৌশল আছে, তেমনি পুলিশও বিভিন্ন কৌশলে তাদের ধরছে। গোপন সংবাদ, গোয়েন্দা তৎপরতা, মোবাইল টিম, হাতেনাতে, চেকপোস্টসহ বিভিন্নভাবে ছিনতাইকারীদের ধরা হচ্ছে। তবে এখন ছিনতাই আগের চেয়ে কমে গেছে।’
ছিনতাই যেমন বাড়ছে, তেমনি ছিনতাইয়ের কৌশলও বহু বিচিত্র। অভিনব। প্রতারণা আর নির্মমতায় ভয়ঙ্কর। সাধারণ বা নানা ছদ্মবেশে হচ্ছে এসব ছিনতাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন বা পাশের ছদ্মবেশী পথচারী রূপ নিচ্ছে ছিনতাইকারীতে। ছোঁ মারছে পাশেরজনকে লক্ষ্য করে। পথচারী বা যাত্রী কিংবা পরিচিত বা স্বজনের ছদ্মবেশ মুহূর্তে খসে পড়লেও করার নেই কিছুই। ততক্ষণে সব নিয়ে পগারপার। পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে চড়ে নানাভাবে হচ্ছে তা।
গত ২৮ জানুয়ারি দুপুরে নগরের হালিশহর থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার মহরম সুলতানা সিক্তা নামের এক নারী। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ২৮ জানুয়ারি দুপুর ২টা ২৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় আসেন ছিনতাইয়ের শিকার মহররম সুলতানা সিক্তা। তার পিছু নিয়ে ২টা ২৯ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে আসে ছিনতাইকারীদের মোটরসাইকেলটি। ১০ সেকেন্ড না যেতেই দৃশ্যপটে হাজির ছিনতাইয়ে সহায়তাকারীদের একটি সিএনজি অটোরিকশা। পরবর্তী ৩০ সেকেন্ডে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি।
নগরীর ব্যস্ততম এলাকায় পায়ে হাঁটা ছিনতাইকারীদের টার্গেটে পড়ছেন পথচারীরা। শিকার হচ্ছেন চলন্ত ও যানজটে আটকে পড়া গাড়ির যাত্রীরা। অটোরিকশার লোহার বেষ্টনীও কাজে আসছে না। চলন্ত ও যানজটে আটকা পড়া অটোরিকশার পেছনে ঝুলে ছাদ ও পাশের বেষ্টনীর রেক্সিন ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যাচ্ছে জিনিসপত্র।
নগরীর লাভলেইন, টাইগারপাস, নিউমার্কেট, হালিশহর, অক্সিজেনসহ অর্ধশতাধিক পয়েন্টে এভাবে ছিনতাই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এসব ছিনতাইয়ে অংশ নিচ্ছে অনেক পড়ালেখা জানারাও। নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য ছিনতাইয়ে নামছে ধনীর দুলালরা।
উপ পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বুধবার ছিনতাইয়ের সময় ধরা পড়াদের মধ্যে তিনজনই লেখাপড়া জানা। কেউ কেউ ভালো চাকরি করে। অতীতের বিভিন্ন ঘটনায় দেখেছি, নেশার টাকা বা অনৈতিক ইচ্ছা পূরণে ছিনতাইয়ে নামছে শিক্ষিত-ভালো পরিবারের ছেলেরা।’
সিএনজিতে ছিনতাই পকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা নানা কৌশল নিচ্ছে। এটি তার একটি। বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।’
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে ছিনতাই-কাজে সিএনজি অটোরিকশার ব্যবহার বেড়েছে। অটোরিকশা চালকরা ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যোগসাজশে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই করে। এসব ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশা ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। অটোরিকশাযোগে ছিনতাইকারীরা রিকশাযাত্রী, পথচারী এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলা রিকশাযাত্রীকেই টার্গেট করছে। এরপর সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে ওই রিকশাযাত্রী কিংবা পথচারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে অটোরিকশাযোগে পালিয়ে যেত ছিনতাইকারীরা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘নানা কৌশলে ছিনতাই করছে। এক কৌশলে কাজ না হলে নিচ্ছে ভিন্ন কৌশল। রাস্তাঘাটে নিরপরাধকে অপরাধী বানানোর কৌশল। গায়ে ধাক্কা, পায়ে পা মাড়ানো, হোঁচট খাওয়ার ভান করে কাছে আসছে। অহেতুক ঝগড়া বাধাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আত্মরক্ষা ও বেশি লাভের কৌশল হিসেবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ভুয়া সদস্য সেজে ছিনতাই করছে। পুলিশ, ডিবি, র্যাব, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়েই তাদের ছিনতাই। মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসে চড়ে করছে ছিনতাই। রাস্তাঘাটে দেহ তল্লাশি, মাদক রয়েছে, গ্রেপ্তার, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি উল্লেখ করে মানুষকে গাড়িতে তুলে নিয়েই জিম্মি করছে।’
বুধবার নেভাল এভিনিউতে ছিনতাইয়ের শিকার মিঠু ঘোষ বলেন, ‘আমাদের পাঁচ-ছয় জনের একটি সমিতি ছিল। সেখানে প্রতি মাসে টাকা করে রাখতাম। মেয়াদ শেষ হওয়ায় বুধবার জুবলী রোডের ঢাকা ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। রিকশায় যাওয়ার সময় নেভাল ক্রসিং এলাকায় পৌঁছলে ছিনতাইকারীরা আমাকে টেনে সিএনজিতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে। এসময় আমাকে মারধরও করা হয়। আমি চিৎকার দিলে ডিবি পুলিশের একটি দল সিএনজিসহ তাদের আটক করে।’
গত ৭ ডিসেম্বর ফিরিঙ্গিবাজারের অদূরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন ব্যবসায়ী আনসার উদ্দিন। ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় আনসারকে ছুরি মেরেছিল ছিনতাইকারীরা। সেদিনের ঘটনার ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিকেল ৩টা ৪১ মিনিটে রিকশা নিয়ে ব্যাংক থেকে ফিরছিলেন ব্যবসায়ী আনসার উদ্দিন। রিকশাটিকে পেছন থেকে অনুসরণ করছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। রিকশার কাছে এসে হঠাৎ থেমে যায় সিএনজি অটোরিকশাটি। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে দৌড়ে রিকশাকে আটকাতে যায় একজন। রিকশাচালক চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর আরো দুজন ওই সিএনজি অটোরিকশা থেকে দৌড়ে নেমে রিকশায় থাকা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেন। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীকে ছুরি মারেন ছিনতাইকারীরা।
ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে বলার সুযোগ নেই। ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। তালিকা করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নগরবাসীর আতংকিত হবার কিছু নেই।’
একুশে/এএ