শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট শিশু!

প্রকাশিতঃ ৮ এপ্রিল ২০১৮ | ৮:৫৮ অপরাহ্ন

শরীফুল রুকন : শিশুদের অপরাধের ধরণ পাল্টেছে। চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের পাশাপাশি শিশুদের খুন-ধর্ষণ ও মাদক পাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ভুল পথে পরিচালিত করছে অপরাধী চক্র। এই শিশুদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের অথবা ছিন্নমূল শিশু।

চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন রোড়ে পুরাতন রেল স্টেশন এলাকায় ফুটপাতে গড়ে ওঠেছে ‘চোরাই মার্কেট’। চুরি-ছিনতাই করা জিনিসপত্র সেখানে কেনা-বেচা হয়। সেখানকার বিক্রেতারা চোরাই জিনিসপত্র কম দামে সংগ্রহ করার জন্য শিশুদের ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ আছে।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে শিশুরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে শিশুদের মাদকাসক্ত বানিয়ে ফেলা হয়। পরে মাদকের লোভ দেখিয়ে নানা অপরাধে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া টাকার লোভেও শিশুরা অপরাধে পা দিচ্ছে।’

এদিকে স্টেশন রোড়ের পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ফুটপাতে প্রায়ই দেখা যায় শিশুদের মাদক বিক্রি করতে। তাদের সামনে এসে ক্রেতারা ১০, ২০ টাকা বের করে দিলেই মুহুর্তেই তারা পকেট থেকে বের করে দিচ্ছে গাঁজার পুটলি। এক পকেটে থাকে ১০ টাকার পুটলি, অন্য পকেটে ২০ টাকার। যার যা চাহিদা, তারা তাই মেটাচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মোস্তাইন হোসেন বলেন, ‘কম মজুরীতে শিশুদের দিয়ে মাদক বিক্রি করা যায়, এজন্য মাদক বিক্রিতে শিশুদের ব্যবহার বাড়িয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এছাড়া খুচরা মাদক বিক্রেতারা শিশু হওয়ায় কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে বড় মাদক ব্যবসায়ীরা। তবুও মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।’

গত শনিবার দুপুর ১টার দিকে পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় মাদক বিক্রি করতে দেখা গেল আনুমানিক ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে। এ প্রতিবেদককে গাঁজার ক্রেতা মনে করে মাদক বিক্রি করার চেষ্টা চালায় সে। শিশুটি ছিল কিছুটা নেশাগ্রস্থ অবস্থায়। কথা বলে জানা গেল, তার বাবা নেই, মা আছে। স্টেশন এলাকায় ভাসমান তারা। আগে লেগুনার চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিল। সেখানে টাকা কম পাওয়ায় সে এখন গাঁজার পুটলি বিক্রি করে। গাঁজা বিক্রি করে দিনে সে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পায়। এছাড়া দৈনিক দুই পুটলি গাঁজা তাকে বিনামূল্যে দেয়া হয়! একদিন খাবার না খেলে তার চলে, কিন্তু নেশা না করলে তার চলে না।

কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে ইয়াবা পাচারকালে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন শিশু আটক হয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) হাসানুজ্জামান মোল্লা বলেন, ‘সাধারণত শিশুদের তল্লাশি করা হয়না। এ সুযোগটা নিয়ে শিশুদের ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবাসহ শিশুদের আটকের ঘটনা বেড়েছে।’

ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরাম- নামের একটি এনজিও চট্টগ্রামের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে। তবে মাদকের সাথে যুক্ত শিশুদের সংখ্যা নিয়ে তাদের কাছে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মেট্টো অঞ্চলের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, ‘কী পরিমাণ শিশু মাদকের সাথে যুক্ত সে ব্যাপারে আমাদের কাছে সঠিক তথ্য নেই। তবে শিশুদেরকে মাদকের কুফল সম্পর্কে অবহিত করতে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থানে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’

শিশু আইন অনুযায়ী, এখন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া নয় বছরের কম বয়সের শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক বা শাস্তি দেয়া যাবে না। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হ্যান্ডকাপ পড়ানো যাবে না। আর শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে। আদালত তাদের বিচার শেষে অপরাধের প্রমাণ পেলে শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে অভিযুক্তদের।

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, ‘শিশু আইনে উল্লেখ আছে, শিশুদের যারা ব্যবহার করে তাদের শাস্তির আওতায় অানতে হবে। কিন্তু বাস্তবে শিশুদের অবৈধকাজে ব্যবহারকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না৷ শাস্তি শিশুদেরই পেতে হয়৷ এমনকি আটক শিশুদের বড় একটি অংশকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় না৷ বয়স বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সাধারণ আইনেই বিচারে সোপর্দ করে পুলিশ৷’

গত ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের জামালখান এলাকায় ছুরিকাঘাতে স্কুলছাত্র আদনান ইসফার হত্যার ঘটনাতে শিশু অপরাধীদের গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা গ্রেফতার শিশুরা ‘হিরোইজম’ বিরোধে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। গ্রেফতার পাঁচজন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আবদুর রউফ নামের এক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছে বলে পুলিশ গণমাধ্যমকে তথ্য দিয়েছে; অথচ এই রউফকে পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসেনি।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আদনান ইসফার হত্যায় গ্রেফতার পাঁচ শিশু দরিদ্র পরিবারের সন্তান। রাজনৈতিক দলের কথিত বড় ভাই তাদেরকে টাকা দিয়ে নানা অপরাধে ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতার অভাব আছে। তারা যে অপরাধ করছে, এই অপরাধের ফলে কী হবে সেটা তারা চিন্তা করছে না। এভাবে নিজেদের জীবন নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে।’

আদনান ইসফার খুনের ঘটনায় আবদুর রউফের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘শিশুদেরকে যারা বিপথে নিয়ে যাচ্ছে বা নিয়ে গেছে তাদের শাস্তি হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বেআইনীভাবে শিশুদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। ১৫-১৬ বছর বয়সের শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে অনেক সময় পুলিশ আদালতে পাঠাচ্ছে। ফলে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিবর্তে তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। এ ছাড়া অনেক সময় আটক শিশুর ছবি প্রকাশ করে কিছু গণমাধ্যম তাকে অপরাধী হিসেবে সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এতে তার সংশোধন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, ‘অপরাধী চক্র পরিকল্পিতভাবে শিশুদেরকে অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে। তারা নিজেদের হীন স্বার্থে শিশুদের ব্যবহার করছে। শেকড়হীন, পথশিশুরা অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট। এর বাইরে পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থার কারণেও কিছু শিশু অপরাধে জড়ায়। শিশুদের নিয়ে আমাদের সবার নতুন করে ভাবা উচিত। ভুল করলে তাদেরকে পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

একুশে/এসআর