বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

এত অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কেন?

| প্রকাশিতঃ ২৯ জুলাই ২০১৬ | ২:৫১ অপরাহ্ন

:: সঞ্জয় দে ::

police line murderমাত্র কয়েকদিন আগেই জার্মানির মিউনিখের শপিংমলে সন্ত্রাসী হামলায় নয়জন নিহত হন। বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সন্ধ্যা থেকে রাতভর প্রচার করেছে হামলাটির খবর। মধ্যরাতে মিউনিখ পুলিশপ্রধান নিশ্চিত করেন, হামলায় তিন যুবক জড়িত, যাদের একজন আত্মহত্যা করেছেন। বাকি দুজনকে ধরতে অভিযান চলার কথাও জানান তিনি। অভিযান যাতে সফল হয়, সেজন্য নাগরিকদের ঘরের মধ্যে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছিল। আতঙ্কের কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর সেই পুলিশপ্রধানই নগরবাসীকে জানান, হামলাকারী আসলে এক ইরানি বংশোদ্ভূত জার্মান যুবক, যে হামলার কিছু সময় পরেই আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ কেন দীর্ঘসময় একজন হামলাকারীকে তিনজন মনে করে পুরো মিউনিখ অচল করে রাখল সেই প্রশ্ন কিন্তু পরদিন নাগরিকদের আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। হামলাকারী কাপড় চোপড় বা অস্ত্রের সক্ষমতা নিয়েও তারা রাতদিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন না। অন্যদিকে ফ্রান্সের নিস শহরে ট্রাক চালিয়ে ৮৪ জনকে হত্যা করা ট্রাক চালককে জীবিত না ধরে কেন পুলিশ গুলি চালিয়ে মেরে ফেলল তা নিয়েও নাগরিক বা রাজনৈতিক দলের কেউ প্রশ্ন তোলেনি। এর আগে প্যারিস হামলায় প্রধান অভিযুক্তরা কেন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে মারা পড়ল- সে বিষয়ে কোনো তর্কযুদ্ধ হয়নি।

অথচ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে তর্কের শেষ নেই। বিশেষ করে কল্যাণপুরে গত সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত পুলিশের অভিযান শেষ হওয়ার ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অভিযানের গুরুত্ব ও সাফল্য ছাপিয়ে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, অভিযানটি সাজানো কি না! কেউ কেউ রীতিমতো যোগ, বিয়োগ করে জানিয়ে দেন- পুলিশ এক অতি দুর্বল স্ক্রিপ্টের মঞ্চায়ন করেছে মাত্র। তারা প্রশ্ন তোলেন জঙ্গিদের কালো পাঞ্জাবি, জিন্স প্যান্ট ও কারো কারো পায়ের কেডস নিয়ে। রাতের বেলায় এ ধরনের পোশাক বাসার ভেতরে কেউ পরে থাকে কি না- তা উল্লেখ করে মশকরায় মাতেন অনেকে। কারো নজর ছিল জানালায় ঝোলানো আইএস-এর পতাকা ও এর পাশের নীল পর্দা নিয়েও। কাপড় কত ঘণ্টায় কতটুকু কুঁচকে যায় তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, পুলিশ সম্ভবত গুলিস্তানের কোনো দোকান থেকে এই পতাকা বানিয়ে ওই বাসার জানালায় টাঙিয়ে ফটোসেশন করেছে। জঙিরাও ছিল রেডিমেড, তাদের মারার পর কালো পাঞ্জাবি পরিয়ে দেয়া হয়েছে মাত্র। মাত্র কয়েকটি পিস্তল উদ্ধার কেন, নিহতদের অনেকের হাতে ছুরি-দা কেন, ছুরি হাত থেকে খসে যায়নি কেন, ছুরির গ্রিপ দুই ছবিতে দুই রকম কেন, পতাকায় গুলি লাগেনি কেন, সত্যিই জঙ্গি থাকলে জীবিত ধরা হলো না কেন, মিডিয়াকর্মীদের অভিযানের সঙ্গী করা হলো না কেন, এলাকার অন্য সব ভবনের গেট বন্ধ রাখা হলো কেন- ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের আড়ালে হারাতে বসে আভিযানটির মূল গুরুত্ব।

প্রশ্ন তোলা সবাই যে উদ্দেশ্যমূলক প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছেন তা নয়, বেশিরভাগই প্রপাগান্ডাকারীদরে কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজের অজান্তেই বিচেবনাহীন অবিশ্বাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর এটাই সম্ভবত ছিল উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের মূল লক্ষ্য। তারা অনেকেই মুখে জঙ্গির বিচার চাইলেও অভিযানের ক্ষেত্রে এমনসব শর্ত আরোপ করেছেন যা অনুসরণ করা পৃথিবীতে কোনোকালে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। বরং ওই রাতে পুলিশের অভিযান প্রথম থেকেই ছিল অনেক গোছাল এবং পেশাদার। এটা সম্ভবত গুলশান হামলার ঘটনা থেকে নেয়া শিক্ষা। সোমবার গভীর রাতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট যথেষ্ট সময় নিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছে, তারা আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয় শর্তগুলো নিশ্চিত করেছে, স্থানীয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখা হয়েছে এমনকি সংবাদকর্মীদের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতেও ছিল তৎপরতা। এর আগে পুলিশের একটি দল এলাকার বিভিন্ন মেসে তল্লাশি চালানোর এক পর্যায়ে জাহাজ বাড়িতে যায়। তারা তৃতীয় তলায় ওঠামাত্র পঞ্চম তলা থেকে ছুটে নেমে আসা জঙ্গিদের কয়েকজন বোমা ছোড়ে বলেই এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে। পুলিশ দল এ সময় গুলি ছুড়লে এক জঙ্গি আহত হয়ে ধরা পড়ে, যার নাম রিগ্যান। পুলিশ দলটি এরপর নিচে নেমে অবস্থান নেয়। কিছু সময়ের মধ্যে আরও সদস্য এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। কল্যাণপুরে থাকা সংবাদকর্মীদের তথ্য বলছে, প্রায় এক হাজার পুলিশ ও র‍্যাব সদস্য এলাকাটি ঘিরে ফেলেছিল। যে ভবনে জঙ্গিদের অবস্থান তার আশপাশের সব ভবন, এমনকি পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটের একটি জানালার উল্টোদিকের ভবনের জানালার পেছনেও মোতায়েন করা হয় পুলিশের স্নাইপার সদস্য। ফলে জঙ্গিদের বের হওয়ার সব পথ ছিল বন্ধ।

ভোর ৫টা ৫১ মিনিটে শুরু হয় অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স। আর আগের কয়েক ঘণ্টা জঙ্গিরা কথিত জিহাদের শ্লোগান দিয়েছে, মাঝে মধ্যে পিস্তলের গুলি ছুড়েছে, যার বিররণ আতঙ্কিত এলাকাবাসীর মুখ থেকেই পাওয়া গেছে। আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের ফেসবুক আপডেটও এ ঘটনার সাক্ষ্য দেয়। এই সময় জঙ্গিদের একেকটি গুলির জবাবে বাইরে থেকে প্রচুর গুলি ছুড়েছে পুলিশ। এটা মোটামুটি নিশ্চিত ফ্ল্যাটে অবস্থানকারীরা ছিল আত্মঘাতী দলের সদস্য এবং সরকার নাকচ করতে চাইলেও বিভিন্ন আলমত বলছে, তারা আইএস অনুসারী। পুলিশি ঘেরাওয়ে পড়ার পর তারা সবাই কালো পাঞ্জাবি কেন পরেছিল তার একটি ব্যাখ্যা আইএসের ড্রেসকোড থেকেই পাওয়া যেতে পারে, যেখানে আত্মঘাতী অথবা উচ্চপর্যায়ের সদস্যদের জন্য কালো পাঞ্জাবি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর আগে গুলশান হামলাকারীদেরও এই রংয়ের পাঞ্জাবি পরা ছবি প্রকাশ করেছে সাইট ইন্টেলিজেন্স। কল্যাণপুরে নিহতদের অনেকেই যে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল সেটি এখন প্রকাশিত হচ্ছে ধরা পড়া জঙ্গির স্বীকারোক্তি থেকে।

কল্যাণপুরের আস্তানাটি থেকে উদ্ধার করা হয় ভেঙে ফেলা ল্যাপটপসহ বেশকিছু ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। এগুলোর থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি ছবি এই কয়দিন প্রপাগান্ডা চালানো ব্যক্তিদের জন্য চূড়ান্ত আঘাত। দেখা যাচ্ছে, মঙ্গলবার ভোরে নিহতরা এর আগে অস্ত্রহাতে হাসিমুখে নিজেরাই ছবি তুলেছিল। তাদের কয়েকজনের হাতে পিস্তল, বাকিদের হাতে ছিল ছুরি ও দেশীয় অস্ত্র। ব্যাকগ্রাউন্ডের জানালায় যে পতাকা ও নীল পর্দা দেখা যাচ্ছে সেটি অভিযান শেষে পুলিশের তোলা ছবিতেও রয়েছে। পার্থক্য শুধু পর্দার একটি প্রান্ত খোলা। মনে রাখতে হবে, অভিযান শেষে পুলিশ কক্ষগুলোতে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েছে। এর কোনো পর্যায়ে পর্দার একটি অংশ খুলে ফেললে নিশ্চয়ই তাদের কাছে জবাবদীহী চাইতে হবে না। মৃতদেহের হাতে থাকা একটি ছুরির গ্রিপে পরিবর্তন একই কারণে হতে পারে। জঙ্গিদের নিজেদের তোলা একটি ছবিতে জানালার পাশের দেয়ালের স্ট্যান্ডের যেখানে যে পোশাকটি ঝুলতে দেখা যায় অভিযান শেষে পুলিশের তোলা ছবিতেও পোশাকটির অবস্থান অভিন্ন। দুই পক্ষের তোলা ছবির মধ্যে এ ধরনের বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখে ধারণা হয়, অন্য কোনো সময়ে নয়, বরং ঘেরাও হয়ে থাকার সময়েই জঙ্গিরা নিজেদের ছবিগুলো তুলেছিল। গুলশানে হামলার ছবি যেভাবে জঙ্গিরাই তুলে বিদেশে পাঠিয়েছিল এবারের ছবির উদ্দেশ্যও হয়ত তাই। জঙ্গিদের অনেকে পেছন থেকে কেনগুলিবিদ্ধ সে জবাব পুলিশ নিশ্চয়ই দেবে, তবে ভবন ঘিরে অবস্থান নেয়া স্নাইপারদের গুলিতেও মারা যেতে পারে কেউ কেউ।

কল্যাণপুর অভিযান নিয়ে বিশ্বাসহীনতার দায় পুলিশকেই দিতে চান অনেকে। তাদের বক্তব্য তথাকথিত ক্রসফায়ার নাটকের একেরপর এক মঞ্চায়নই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। এই বক্তব্য মোটেই উড়িয়ে দেয়ার নয়। তবে মুশকিলটি হলো- ঢাকা শহরের মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি বাড়ি দীর্ঘ সময় ঘিরে রেখে এ ধরনের নাটক সাজানো সম্ভব কি না সেই বিচারবুদ্ধিও নাগরিকদের থাকা প্রয়োজন। এর আগে এমন কোনো ঘটনা কি দেখানো যাবে যেখানে ‘ক্রসফায়ার’ গল্পে এলাকা সবাই সায় দিচ্ছেন, আতঙ্কিতরা ফেসবুক আপডেট দিচ্ছেন, পাড়ার নৈশপ্রহরী জঙ্গিদের ছবি শনাক্ত করে বলছেন, তাদের একজন কিছুদিন আগে তাকে মারধরও করেছিল! পুলিশের তথাকথিত ক্রসফায়ার বন্ধে নাগরিকদের অবশ্যই প্রবল সোচ্চার থাকতে হবে। তবে অসংখ্য প্রমাণের পরেও আসল বন্দুকযুদ্ধকে উপহাসের প্রবণতা কিন্তু নকল বন্দুকযুদ্ধ অব্যাহত রাখার সুযোগও তৈরি করে। আর তাতে সুযোগসন্ধানীদের লাভ হলেও শেষপর্যন্ত ক্ষতি কিন্তু সাধারণ মানুষেরই।

লেখক: সাংবাদিক