
মো : আবদুল মান্নান :
১. গত সপ্তাহে মধ্যকার্তিকের একটি হৈমন্তি বিকেলকে একটু অন্যভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিদর্শন শেষে কুমিল্লার দিকে চলেছি। সফরসঙ্গী অনুজ সহকর্মী জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে গল্পে-গল্পে কুমিল্লা পৌঁছে যাই। নিজেও একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাপ্রশাসক ছিলাম বিধায় জেলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে নবাগত জেলাপ্রশাসকের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনারও সুযোগ পেলাম।
২। সন্ধ্যের একটু পূর্বেই কুমিল্লায় পৌঁছি। সার্কিট হাউসে খুব অল্প সময় অবস্থান করে সোজা শহরের লাকসাম রোডের ঐতিহাসিক রামমালা লাইব্রেরিতে যাই। সঙ্গে সহকর্মী আবুল ফজল মীর জেলাপ্রশাসক, কুমিল্লা, পাঠক সমাবেশের স্বত্তাধিকারী বন্ধু বিজু ও অন্যান্য অনুজ সহকর্মী। জীবনে প্রথমবার এমন একটি স্থানে প্রবেশ করে একই সাথে আনন্দিত ও লজ্জিত হলাম। কারণ দীর্ঘ সময় এ বিভাগে চাকরি করেও ইতোপূর্বে কেন আসিনি। আনন্দিত হলাম, পৃথিবীর বিচিত্র রকম পুঁথিপুস্তকের এমন সংগ্রহ দেখে।
রামমালা গ্রন্থাগার, মহেশাঙ্গন কুমিল্লা, লেখাটি প্রথমেই চোখে পড়লো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামের জনৈক মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য তাঁর মা প্রয়াত রামমালা দেবী’র স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯১২খ্রিস্টাব্দে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। মহাপ্রাণ মহেশ ভট্টাচার্য্য ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত না হলেও দীর্ঘ ৮৬ বছরের মহাজীবনকে নিবেদন করে গেছেন মানবজাতির কল্যাণে। একই স্থানে তিনি যথাক্রমে তাঁর বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বর পাঠশালা। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রামমালা হোস্টেল এবং ১৯১৯ সালে নিবেদিতা গার্লস হোস্টেল।
৩. রামমালা লাইব্রেরিতে বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ছাড়াও পৃথিবীর নানা ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে। যা শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয়, অন্যত্র অদৃশ্য হতে পারে। জানা যায়, এখানে ১২,০০০ ছাপানো বই, ৮,৫০০ হাতে লিখা বই যার বেশির ভাগই মধ্যযুগের ছাপাখানার স্বাক্ষর বহন করে। প্রায় ২,০০০ বই তালপাতায় (Palm leaf) লেখা। ১৭০০খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাপ্ত পুস্তকের সংখ্যাই এখানে বেশি। পুস্তকের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, নাটক, যাদুবিদ্যা, রাজনীতি, দর্শনসহ বিচিত্র সব সংগ্রহ। এখানে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এর অ্যানসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ, বাইবেল সবই রয়েছে। তালপাতায় লেখা বইগুলোতে স্পর্শ করা খুবই স্পর্শকাতর। এগুলো কালের প্রবাহে ঝুরঝুরে হয়ে পড়েছে। লেখাগুলো ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো পাঠোদ্ধার সম্ভব হবে না। বর্তমানে এ লাইব্রেরির পুস্তকসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করে পৃথক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- ১) তুলনামূলক ধর্ম বিভাগ ২) জেনারেল বিভাগ ৩) পুঁথি বিভাগ।
৪. রামমালা বিগত একশ’ বছরে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক, লেখক, সাহিত্যিক, ছাত্র-ছাত্রী দ্বারা অভিষিক্ত হয়েছে। একে বলা হয়েছে, “A light house of undivided India”। এ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাকালে মহেশ ভট্টাচার্য্য তাঁর নিজের উপার্জন যেমন ব্যয় করেছেন তৎকালীন স্থানীয় বিত্তশালীগণও বইপুস্তক দানে এগিয়ে এসেছিলেন। কালক্রমে এর সম্প্রসারণ ঘটলে মহেশ বাবু চাঁদপুর থেকে জনৈক ডা. রাসমোহন চক্রবর্তীকে নিয়ে আসেন ‘কেয়ার টেকার’ হিসেবে। রাসমোহন বাবুই একে নিজের সন্তানসম যত্নে লালন করে এক মহিরুহে পরিণত করেন।
৫. জানা যায়, ১৯৭১ সালে লাইব্রেরিটি বড় হুমকির মুখে পড়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। কারণ পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী সে সময় কুমিল্লায় নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সৈনিক অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া’র রামরাইলে জন্মগ্রহণ করেন।
দর্শনকালে আরও জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন পাকিস্তানী মেজর রামমালায় প্রবেশ করেছিল। এটি পুড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। ভেতরে ঢুকেই পবিত্র কোরআন শরীফ সামনে পেয়ে তারা নাকি ফিরে যায়। এভাবেই রামমালা তখন রক্ষা পায়।
৬. রামমালায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচিহ্ন পড়ে ১৯২৬ সালে। রামমালার উভয় হোস্টেলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকবৃন্দ সেদিন কবিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। রবি ঠাকুর মহেশ বাবুকে খুবই প্রশংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোলকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখার সাথে লাইব্রেরির বইয়ের তুলনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালে কবি হুমায়ুন কবীর ১৯৩২ সালের ২২ মার্চ রামমালা পরিদর্শন করেন।
উল্লেখ্য, হুমায়ুন কবীর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের একান্ত সচিব এবং পরবর্তীতে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। রামমালায় রক্ষিত পরিদর্শন বইয়ে মহারথীদের মন্তব্যগুলোও মহামূল্যবান ইতিহাসের অংশ হতে পারে।
৭. রামমালা দর্শন বিলম্বে হলেও সুখকর হয়েছে। মহামতি মহেশ ভট্টাচার্য্য তাঁর জীবন ও কর্ম প্রাত:স্মরণীয়। এমন মহাপ্রাণদের মৃত্যু নেই। তাঁরা ইতিহাসের অমর উপাখ্যান হয়ে থাকেন। জানা যায়, জীবদ্দশায় মহেশ বাবু, তাঁর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে দেশ-বিদেশ থেকে বই পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতেন, অন্য কিছু নয়।
রামমালা লাইব্রেরিসহ সমগ্র কমপ্লেক্সই বাংলাদেশ এবং বিশ্ব বইপ্রেমী মানুষের অমূল্য সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। অনাদি, অনন্তকালের বাতিঘর হয়ে রামমালা লাইব্রেরি জেগে থাক আলোর সারথি হয়ে।
লেখক : বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম।