শাহানা ইয়াসমিন : শহরের যান্ত্রিকতায় আমরা প্রকৃতিকে ক্রমান্বয়ে পর করে দিচ্ছি। অনেক রঙ্গে রাঙানো প্রজাপতি হাতের তালুতে নেয়া হয় না। পিচঢালা পথ ছাড়িয়ে চকচকে সবুজ ঘাস মাড়াতে ভুলে গেছি। জোনাক মুগ্ধতা আমাকে ছুঁতে পারে না বুহুদিন। গাছের ফল ছেঁড়া আর ফল কুড়ানো কেমন যেন স্বপ্নের মতন হয়ে গেছে। ঝিরঝিরে একটা শান্ত নদীর সাথে কথা বলা হয় না ব্যস্ততার কোলাহলে। কেমন যেন সব অতীত স্মৃতির মোড়কে মুড়িয়ে যাচ্ছে। অলস সময়ে বিষয়গুলো ভাবায়, আতংকিত করে। আমরা তাও প্রকৃতিতে দূরন্ত বেপরোয়া শৈশব-কৈশোর পেরোতে পেরেছি। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম তা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত। মন খারাপের ভেলায় নিজের অজান্তেই ভাসতে থাকি।
সভ্যতা যন্ত্র দিয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই যন্ত্র বনে যাচ্ছি। আজকের প্রজন্ম পাশেই বসে থাকা বন্ধুর সাথে কোলাহলে মাতে না। তার অস্তিত্বের গুরুত্ব নেই ঠিকই। তবে স্ক্রীনে থাকা বন্ধু্র সাথে বাংলিশ চ্যাটিংয়ে বিভোর। সেদিন ভার্সিটির হলে গেলাম, অনেক দিন পর। হলের ভেতরে পা রাখতেই একটা বিষয়ে খটকা লাগল। শান্ত, নিরব, নেই কোন কোলাহল, খিলখিল, প্যারডি গান, দল বেঁধে হাঁটা, অস্থিরতা। ভাবলাম, কোথায় গেল সব। বন্ধ নাতো? কিছুক্ষণ পর টের পেলাম আধুনিকতার ছোঁয়া, সবাই নাক মুখ ডুবিয়ে রেখেছে মোবাইলে বা ল্যাপটপে।সত্যি কথা বলতে কি, আমার ফেলে আসা হল চত্বরে মুখরিত এ প্রজন্মের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার লোভেই আমার সেখানে যাওয়া। কিন্তু পরিবর্তনের পারিপার্শ্বিকতা তাতে বাধ সাধলো।
আমরা সবাই যেন কিছু একটার পেছনে অনর্গল ছুটে বেড়াচ্ছি। স্বস্তি নেই, নেই নিরিবিলি অলস আয়েসী কোন বেলা। হাফিয়ে ওঠা জীবন রুটিনে তাল মেলাতে মেলাতে চারপাশের সবাই ক্রমশঃ ফেইক বা কৃত্তিমতার খোলসে জড়িয়ে ফেলছে নিজেকে। অনুভূতির গভীরতায়ও অগাধ অঢেল অফুরান বলে কিছুই নেই, আজকাল। যে কারণে সমাজে সম্পর্কগুলোর বাঁধন এতই হালকা যে, যখন তখন ভেঙে যাচ্ছে। আনকোরা সম্পর্কগুলোও স্বার্থের স্বর্ণ শেকলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।
জীবনটাকে বোঝা মনে হয়, মাঝে মাঝে। অহেতুক প্রতিযোগিতা, লোক দেখানো লৌকিকতায় ঝলসে যাচ্ছে শিশুমনের বিকাশ। রোবটের মতন পাল্লা দিয়ে ছুটছে তারা, সাথে মা-বাবা। টেনশন আর অস্থিরতায় অসুস্থ চারপাশ।
প্রয়াত আনিসুল হক বলতেন, “Life is not a race. এর কোন backspace নেই, delete করা যায় না। একবার যদি আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই জীবনে পেছনে ফিরে যাওয়া যায় না। life এ কম্পিউটারের মতন কোন backspace নেই। আমরা বলি মানুষ স্বপ্নের চেয়ে বড়।আবুল কালাম সাহেব বলেছেন, রাতের স্বপ্ন নয়, দিনের স্বপ্ন দেখো। সায়িদ স্যার বলেন, মানুষ স্বপ্নের সমান বড়, স্বপ্নের চেয়েও বড়। আসলে মানুষ স্বপ্ন যদি ঠিকমত দেখে, তখন মানুষ স্বপ্নকে পেরিয়ে যায়।
চারপাশের জগতে অনেক খ্যাতি, স্বীকৃতির ছড়াছড়ি। রয়েছে রক্তঝরা গৌরবোজ্জল ইতিহাস। তবুও কোথায় যেন একটা খটকা থেকেই যায়। তৈরী হচ্ছে না সেরকম শিল্পী, অভিনেতা, কথাশিল্পী, সাহিত্যিক। চোখ ধাধানো হঠাৎ চমক দেয়া ঠুনকো খ্যাতি আমাদের সমাজে ব্যাধির মতন ছেয়ে যাচ্ছে। নিরবেই ঝরে যায়, হারিয়ে যায় তারা। রেখে যেতে পারে না কোন ছাপ। বিভিন্ন সেক্টরে নৈতিকতা, মূল্যবোধকে যেন আবর্জনার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমরা সবাই টাকার পেছনে ছুটে চলছি। সকল কর্মপ্রচেষ্টা, এ প্রজন্মের ভবিষ্যত জীবনের লক্ষ্য, স্বপ্ন সবই ওই টাকাকে ঘিরে।
বোধকরি মোটা সার্টিফিকেটধারীর সংখা যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে বাড়ছে না সত্যিকার অর্থধারণকারী মানুষ। তবুও আমি আশাবাদী। হঠাৎ চমকে দেয়া কিছু নির্ভিক, সাহসী, সত্যিকারঅর্থে মানবদরদী ব্যাক্তিত্ব চোখে পড়ে। একজন সরকারী বড় কর্মকর্তার (পরিচয় অপ্রকাশ রাখলাম) কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যার চোখে পড়ে, সেন্টমার্টিনে মানুষের চেয়ে কুকুর বেশী। কাসিমের জন্য ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ অথচ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ থাকে পলিথিনের ঘরে। আমি দেখেছি তাঁর কাছে দীনহীন দরিদ্র মা মলিন পোশাকে অনায়াসেই সকল প্রটোকল পেরিয়ে সন্তানের বিপদের কথা বলতে পারে। শুধু তাই নয় নিজেই ফোন তুলে নেন সব কর্মব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে, ঐ মায়ের জন্যে। আমি দেখেছি এক বৃদ্ধ মা তার মেয়ের দূরান্তে বদলীর জন্যে অভিযোগের ডালি নিয়েও পেয়েছেন বটবৃক্ষের ছায়া। একজন সামান্য কন্সটেবল সহজেই তার সামনে দাঁড়িয়ে বিচারের জন্য আবেদন করতে পারে দেখলাম। সরকারী এত বড় একজন কর্মকর্তার মধ্যে নেই কোন অহংকার। শোষিত মানুষের জন্য তার স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠা, সকল কর্মব্যস্ততার শেষে ছুটির দিনেও কোন একটা স্কুলে কাটিয়ে দেন সারাটা দিন, জগতের সকল সেক্টরে তার জ্ঞানের পরিধি অনেক ব্যাপক। তার লেখনীর প্রতিটি শব্দে, বক্তৃতার প্রতিটি বাক্য বয়ান করে যে, একজন সত্যিকার ভাল মানুষ তিনি। কেবল বড় মানুষ নন, বড় মাপের মানুষ।
পদমর্যাদার সাথে খাপ খাইয়ে জ্ঞান, মেধা, সততা নিষ্ঠা আর মানুষের জন্যে কিছু করার আকুতির ব্যাপ্তি বড্ড বিরল। তবুও পৃথিবী এগোয়, সময়ের পসরায় ভেসে যায় প্রেক্ষাপট, অতীত। আমরা স্বার্থচিন্তা ভুলে, কেবল অন্যকে ফেলে নয় একসাথে উপরে ওঠার সিড়ি বেয়ে চলা, সততার জন্যে অনঢ়, আর বিরল ব্যাক্তিত্বের অনুসারী হলে দিনে দেখা স্বপ্নগুলোতে ইচ্ছেমতন রঙ লাগাতে পারবো। প্রযুক্তি নয় আমরাই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবো। অসুস্থ প্রতিযোগীতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়টা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে চলে আসবে। আমরা শুধু বাহ্যিক চেহারার মানুষ নয়, সত্যিকারের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ পেতে চাই।
লেখক: প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম।