মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী : ‘শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড’- এ আপ্তবাক্যটি সভ্যতার উষালগ্ন থেকে চালু রয়েছে। কেননা শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষা তথা জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি শৃঙ্খলা, সৃজনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান এবং দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে অহংকার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অন্ধকার বলয় ভেদ করে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এ দেশটি স্বাধীন করেছে বীর বাঙালি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যা করে যে অপশক্তি এদেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছিল, একবিংশ শতাব্দীর আজকের এ সময়ে এসে তাদের সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়েছে।
স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়ের নাম। কারণ এ জাতি নিজ রক্তে রঞ্জিত হয়ে জন্ম নেওয়ার পর একে একে অপশক্তিগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে স্বকীয় মহিমায়। বিপ্লবী জাতি হিসেবে পৃথিবীর কাছে আত্মপ্রকাশ পাওয়া এ জাতি এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য আর উন্নয়ন-সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা-ই এ দেশকে নিয়ে গেছেন সমৃদ্ধি অনন্য উচ্চতায়। তাঁর গভীর দেশপ্রেম, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির আলোকে বদলে গেছে এ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্র। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য নজির। শিক্ষাব্যবস্থায় সাধিত হয়েছে বৈপ্লবিক উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রীর আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাদর্শন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এনে দিয়েছে বিপ্লব। যার ছোঁয়া লেগেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও (চবি)।
১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা বিশ^মানের শিক্ষার্জনের দিকে এগিয়ে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ‘বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান সৃজন ও জ্ঞান বিতরণের তীর্থকেন্দ্র’ এ বিষয়টিকে ধারণ করে প্রযুক্তির সমন্বয়ে আধুনিক মানসম্মত শিক্ষা, সমৃদ্ধ গবেষণা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অপার সম্মিলন ঘটানোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, গবেষণা ও তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিকে এ বিশ্ববিদ্যালয় এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রকৃত অর্থেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন দৃশ্যমান।
বিগত কয়েক বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। অতীতের মতো ছাত্র অসন্তোষ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত সাড়ে তিন বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একদিনও বন্ধ রাখতে হয়নি। ফলে উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বড় অভিশাপ সেশনজট এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নান্দনিক সৌন্দর্যের দিক থেকেও এগিয়েছে বহুগুণে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধিচর্চার একটি সমৃদ্ধ উদ্যান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সম্মিলন এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে একটি অনন্য রূপ। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চর্চার পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার সব আয়োজন রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে এ ক্যাম্পাসে সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবহ তৈরি করা হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিময় অবস্থান আমাদের প্রত্যাশা। কারণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের স্বীকৃত মানদণ্ডের কথা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চারই জায়গা নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও দেশপ্রেমের মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়ারও স্থান। তাই শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি শিক্ষাসহায়ক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হওয়া উচিত। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের সুপ্ত প্রতিভা স্ফুরণের যেমন সুযোগ পায়, তেমনি নিজেদের ভুল পথে পরিচালিত করারও সুযোগ রয়েছে এখানে। শিক্ষাসহায়ক কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের মননকে সমৃদ্ধ করে, বিকশিত করে সুপ্ত প্রতিভা। নিজেকে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে বিচরণের যে সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণাচর্চায় আত্মনিয়োগ করতে পারলেই বিশ্বজয়ের পথের স্বপ্ন দেখাও সম্ভব। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে আসা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন হোক সমৃদ্ধ।
লেখক: অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং প্রক্টর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।