‘আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝর্ণাকলম করে ডট্ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড় বাবু কবে হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’- তারাপদ রায়
চৈত্রের এই সময়টাতে এসে প্রহর যখন শেষ হয় আলোয় রঙিন হয়ে উঠে তখন প্রিয়জনের চোখে সর্বনাশ দেখতে ভালোই লাগে হয়তো কারো কারো। এসব সর্বনাশে ভালোবাসার ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু জীবনের সর্বনাশও কি সেই ইঙ্গিত দেয়? কেউ অজান্তে বা কেউ ফাঁদে পড়ে ডেকে আনে সর্বনাশ। আবার এমনও হয় আমরা জাতিগতভাবে হয়তো এমন। অন্যের জীবনে অশান্তি এনে দেয়াই আমাদের একমাত্র শান্তি। তবে জীবনকে যদি সুন্দর করতে চান বা সঠিকভাবে এগুতে চান প্রয়োজন একজন মেন্টর। বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমার গবেষক বন্ধু রউফুল আলম। চিঠি দিও কলামের পাঠকের জন্য সেটি এখানে তুলে ধরলাম। ‘জীবনে একজন মেন্টর লাগে। একজন কোচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা চাকরি জীবনে হোক, ছাত্রাবস্থায় হোক আর বেকার জীবনেই হোক। জীবনে কাজ করবেন একজন মেধাবী বসের অধীন। জাঁদরেল বসের অধীন। তাহলে আপনি নিজেও একসময় জাঁদরেল হতে পারবেন। জাঁদরেল মানে হলো আধুনিক, ব্রিলিয়ান্ট, স্ট্রেটেজিক ও চ্যালেঞ্জ নেয়ার মতো সাহসী। আফ্রিকান এক প্রবাদ আছে—An army of sheep lead by a lion can defeat an army of lion lead by a sheep.
নেতৃত্ব যদি সিংহের মতো হয়, তাহলে আপনি ভেড়ার মতো হলেও অনেক কিছু জয় করতে পারবেন। কিন্তু নেতৃত্ব যদি ভেড়া হয়, আপনি সিংহ হয়ে তেমন কোনো লাভ হবে না। এটা সমাজের সবর্ত্রই সত্য। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
স্টুপিডের পদলেহন করে আপনি হয়তো সাময়িকভাবে দৃশ্যত উপরে উঠতে পারবেন—তাতে তৃপ্তি থাকবে না। এবং আপনি জানবেনও না কি করে অর্জন ধরে রাখতে হয়। পতনও হবে দ্রুত। সুতরাং পতনের সময় আপনি শূন্যহস্তে কাতরাবেন। জীবনকে যেহেতু আমরা যুদ্ধক্ষেত্র বলি, সুতরাং সেই যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু রেজাল্ট, সনদ, অর্থ এগুলোই যথেষ্ট নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে স্ট্রেটেজিক হতে হয়। স্ট্রেটেজি না জানলে প্রচুর সৈন্য ও গোলাবারুদ নিয়েও যুদ্ধ হেরেছে অনেক বীর। দুঃখজনক হলো, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু বলে মেধাবী হতে। ভালো রেজাল্ট করতে। ভালো চাকরি পেতে। কিন্তু স্ট্রেটেজিক হতে শেখায় না। জীবন তো ভালো রেজাল্টের চেয়ে অনেক বড়ো। অনেক কঠিন। অনেক কন্টকাকীর্ণ।
‘দ্যা আর্ট অব ওয়ার’ নামক বিখ্যাত বইয়ের লেখক Sun Tzu লিখেছেন—Strategy without tactics is the slowest route to victory. Tactics without strategy is the noise before defeat. তিনি হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য বুঝিয়েছেন। কিন্তু এটা জীবন যুদ্ধের জন্যও খাটে। জীবনেরও কিছু ‘সেটস অব রুল’ আছে। সেগুলোর প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ, ভুল প্রয়োগে জীবন বহুদিকে বাঁক নেয়। তরুণরা, শুধু ভালো রেজাল্টের পিছু দৌঁড়ে নিঃস্ব হয়ো না। বলছি না, ভালো রেজাল্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলছি, শুধু সেটার জন্য জীবনের দারুণ সময় শেষ করলে হবে না। You have to learn strategy to win the life, to enjoy the every bit of life. You have to learn how to push the boundary without hurting yourself!
আর এজন্যই প্রয়োজন একজন মেন্টর। একজন গুরু। একজন শিক্ষক। একজন গাইড। সেটি হতে পারে বাবা বা মা। হতে পারে শিক্ষক। হতে পারে বস’। কারণ তিনি তার অনুজের জন্য জীবন গড়ে দিতেও সহায়তা করেন। তিনিই বুঝিয়ে দেন ব্যর্থতা মানে সফলতার সিঁড়ি। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। ‘এক লোক পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অবাক হয়ে দেখছিলেন অনেকগুলো হাতিকে চিকন সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতি গুলো চাইলেই তা ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব, কিন্তু তা না করে হাতিগুলো দাঁড়িয়ে আছে!
পাশে বসা ট্রেইনারের কাছে জানতে চাইলেন, বিষয়টা কি? তিনি জানালেন ছোট বেলায় হাতিগুলোকে এরকম দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিলো, তখন ছোট ছিল বলে তারা দড়ি টানাটানি করে ও ছিঁড়তে পারেনি। তাদের এখনো ধারণা তারা এই দড়ি ছিঁড়তে পারবে না, তাই ছিঁড়ার চেষ্টা ও করে না!
তাদের এই অন্ধ বিশ্বাসই তাদের পরাধীনতার কারণ।
এই হাতি গুলোর মতোই কিছু মানুষ আছে যারা জীবনে একবার ব্যর্থ হয়েছেন বলে আর কখনো চেষ্টা ও করেননি! ব্যর্থতা মানে পরাজয় না, বরং এটা শিক্ষা। তাই প্রথম প্রথম ব্যর্থ হলে হার মেনে নেওয়া যাবে না, লেগে থাকতে হবে কাংখিত লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত। ব্যর্থতার কারণ খুঁজে নিয়ে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করতে হবে। হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাইতো পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত শিল্পী কবীর সুমন গেয়েছেন, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে, দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে’। এ প্রসঙ্গে বোকা পাখি বলে পরিচিত কাকের পানি পানের গল্পটা একবার মনে করতে পারি।
যে কাক কলসীর নিচের পানি পান করার জন্য ধৈর্য্য নিয়ে পাথরের টুকরো কলসীর মধ্যে ফেলেছিল এবং পরে পানি উপরে উঠলে পান করেছিল। আমরা যাকে বোকা বলি এই গল্পে কিন্তু সে বুদ্ধিমান। তেমনি লোকে বলে, অন্যের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখার জন্য কাক নিজেই চোখ বন্ধ করে কোথাও গুঁজে রাখে। ভাবে, কেউ দেখেনি। কিন্তু পরে নিজে আর তা খুঁজে পায় না।
এমন বোকা পাখি কাকের একটি বিশেষ প্রজাতির রয়েছে অনন্য দক্ষতা। ছোট ছোট কাঠি ও অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করে এরা খাবার সংগ্রহ ও বিলিবণ্টন করতে পারে। প্রাণিজগতে এটা এক বিরল দক্ষতা। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এই বিশেষ প্রজাতির কাকের বসবাস। এরা নিপুণ দক্ষতায় লম্বা কাঠি ব্যবহার করে মাংস বা খাবার সংগ্রহ করে। প্রয়োজন অনুযায়ী কখনো সেই কাঠি ছোট করে নেয়। উদ্ভিদের লতাপাতা বা বাকল দিয়ে কাঠি বানিয়েও নিতে পারে। এবার বলি সেই কাক কিন্তু একমাত্র প্রাণি যে কখনো দ্বিতীয়বার জোড়া বাঁধে না। কারণ সে কখনো সঙ্গী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারে না। কাক জানে, দ্বিতীয়বার যে আসে সে ভালোবেসে আসে না। বিপদে পড়ে আসে, তখন সবকিছু থাকলেও ভালোবাসা থাকে না। তেমনি যে মেন্টর ভালোবেসে প্রিয় শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন সেই শিক্ষার্থী উন্নত হতে বাধ্য।
শান্তনু চৌধুরী : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক