
তুরস্কে প্রায় চার দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ ও সংগঠন বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি—পিকেকে।
পিকেকে নিয়ন্ত্রিত ফিরাত নিউজ এজেন্সি গতকাল (সোমবার, মে ১২) এ তথ্য জানিয়েছে। ইরাকের উত্তরাঞ্চলে গত শুক্রবার শেষ হওয়া পিকেকের ১২তম কংগ্রেসে এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তুরস্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ কুর্দি। ১৯৮০-এর দশক থেকে তুরস্কে সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকা পিকেকে কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বিদ্রোহ শুরু করলেও, সময়ের সঙ্গে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী লক্ষ্য থেকে সরে এসে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন ও কুর্দি অধিকারের দাবিতে মনোনিবেশ করে। এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশের কাছে পিকেকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত।
পিকেকে নেতা ৭৬ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ ওজালান ১৯৯৯ সাল থেকে তুরস্কে একাকী বন্দি। গত ফেব্রুয়ারিতে অনুসারীদের অস্ত্র ত্যাগ ও সংগঠন ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। কারাগার থেকে লেখা এক চিঠিতে ওজালান বলেছিলেন, “একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা অর্জন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক ঐকমত্যই মৌলিক পথ।” শুক্রবার শেষ হওয়া পিকেকের কংগ্রেসে ওজালানের একটি বিবৃতি পড়ে শোনানো হয়, যেখানে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রস্তাব তুলে ধরেন।
পিকেকের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম কুর্দি অধিকার দমনের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে। পিকেকে তার ঐতিহাসিক মিশন সম্পন্ন করেছে। ১২তম কংগ্রেসে পিকেকের সংগঠনগত কাঠামো ভেঙে দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পদ্ধতি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে পিকেকে নামে পরিচালিত সব কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো।”
তুরস্কের শাসক দল একে পার্টির মুখপাত্র ওমের জেলিক বলেন, “যদি পিকেকের এ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় এবং তাদের সব শাখা ও অবৈধ কাঠামো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে এটি একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন হবে।” ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট নেচিরভান বারজানি এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “পিকেকের নিরস্ত্রীকরণ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা শক্তিশালী করবে।”
তবে পিকেকের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার বিস্তারিত এখনো অজানা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া, নজরদারির ব্যবস্থা এবং পিকেকে যোদ্ধাদের ভবিষ্যৎ—তারা তৃতীয় দেশে চলে যাবে কিনা এসব প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর নেই। ওজালান ও তার সমর্থকরা পিকেকে বিলুপ্তির বিনিময়ে কী পাবেন তাও স্পষ্ট নয়। কুর্দি রাজনীতিবিদরা একটি নতুন রাজনৈতিক সংলাপ ও কুর্দি অধিকারের দিকে অগ্রগতির আশা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে যে ওজালানকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের জোটসঙ্গী ও কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক দেভলেট বাহচেলি গত অক্টোবরে নতুন শান্তি প্রস্তাব দিয়ে ইঙ্গিত দেন যে পিকেকে অস্ত্র পরিহার করলে ওজালানকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। পরে এরদোগান ফেব্রুয়ারিতে বলেন, “এটি সন্ত্রাসের প্রাচীর ভাঙার পথে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।”
তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কুর্দিপন্থী ডিইএম পার্টি (প্রাক্তন এইচডিপি) পিকেকে নেতা আব্দুল্লাহ ওজালানের শান্তির আহ্বান বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দলটির উপনেতা তায়িপ তেমেল রয়টার্সকে বলেন, “এ সিদ্ধান্ত কেবল কুর্দিদের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ঐতিহাসিক। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য তুর্কি রাষ্ট্রযন্ত্রের মানসিকতায় বড় পরিবর্তন দরকার।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘটনাটি তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে, যেখানে সুবিধা পাবেন এরদোগান। তারা সতর্ক করছেন, এ ঘোষণার মাধ্যমে শুধু তুরস্ক নয়, প্রতিবেশী ইরাক ও সিরিয়াতেও প্রভাব পড়বে। পিকেকের বিদ্রোহী অবস্থান ইরাকের কুর্দি শাসিত তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা তৈরি করছিল। অন্যদিকে সিরিয়ার নতুন প্রশাসন উত্তরাঞ্চলে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে।
বিশ্লেষকরা আরও সতর্ক করে বলছেন, শান্তি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। তা রক্ষা করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আস্থা পুনর্গঠন ও সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এখন দেখার বিষয়, এরদোগান প্রশাসন সত্যিই সেই পথে হাঁটবে কিনা।