বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

অর্ধসত্য ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক : একুশে পত্রিকা সম্পাদক

| প্রকাশিতঃ ২৯ জুলাই ২০১৮ | ২:৪৫ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রাম : ‘একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার বলেছেন, আহমদ ছফা সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী একথা মিথ্যে নয়। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হবে এটি তাঁর অসম্পূর্ণ, অর্ধসত্য পরিচয়। অর্ধসত্য ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক হয়। কাজেই আহমদ ছফাকে কেবল সাহিত্যিক কিংবা বুদ্ধিজীবী বলাটা যথার্থ হবে না।। আহমদ ছফা এক বিস্তৃত অধ্যায়, সাহিত্য-প্রতিষ্ঠান।

তিনি একাধারে সমালোচক, অনুবাদক, মুক্তিযোদ্ধা, প্রথাবিরোধী সাহসী লেখক। কোনো ভনিতা, রাখঢাক না করে অকপটে সত্য কথাটিই সবসময় নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্যদিয়ে জাতির সামনে তুলে ধরতেন। এখানেই আহমদ ছফা ব্যতিক্রম, অনন্য সাধারণ।’

শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ পৌরসভা অডিটরিয়ামে শুদ্ধ বানানচর্চা (শুবাচ) আয়োজিত বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ আহমদ ছফার ১৮ তম প্রয়াণ দিবসের আলোচনা সভায় সম্মানীয় অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

শুদ্ধ বানান চর্চার সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের সঞ্চালনায় এবং সংগঠনরে সভাপতি, লেখক-ছড়াকার শাহজাহান আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন চন্দনাইশ পৌর মেয়র মাহবুবুল আলম খোকা।

অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন কমিশনার, নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক একরাম হোসেন, লেখক-গবেষক এম ওসমান গণি, পিপিএস পরিচালক নুরুল হক চৌধুরী, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজের অধ্যাপক তৈয়বুর রহমান, গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ্দিন, স. ম জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন মিঠু, অধ্যক্ষ ইউনুছ কুতুবী। বক্তব্য রাখেন রতন দাশগুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম, একেএম ইউসুফ, তানভীর সিদ্দিকী, জসিম উদ্দিন, আহমদুর রহমান, বাদশা মিয়া, জাকের হোসেন, মহিউদ্দিন ইছা, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

সাংবাদিক আজাদ তালুকদার বলেন, আহমদ ছফা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ তুলে ধরেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির নোংরা খেলা নিয়ে রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস গাভীবৃত্তান্ত। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধ গ্রন্থে তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক মুসলমানদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। যেটি ছিল বাংলা সাহিত্যে রচিত গত শতাব্দির সেরা দশ চিন্তার বইয়ের একটি। এ কারণে মীর মোশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলামের পরে আহমদ ছফাকে বলা হয় বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রগণ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদর্শ আহমদ ছফার মৃত্যুবার্ষিকীতে রাষ্ট্র কিংবা সরকারের কোনো আয়োজন না থাকার সমালোচনা করে জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার, জাতীয় বুদ্ধিজীবী-সবাই আহমদ ছফা ইস্যুতে অন্ধ, বধির ও বোবা হয়ে আছে। অনেকের নামে ছাত্রাবাস হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হয়, গবেষণা কেন্দ্র হয়। আর আহমদ ছফাকে নিয়ে ঘটা করে একটি স্মরণানুষ্ঠান হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই দীনতা আমাদেরকে লজ্জিত করে, বিব্রত করে। বলেন আজাদ তালুকদার।

একুশে পত্রিকা সম্পাদক বলেন, জীবদ্দশায় আহমদ ছফা ছিলেন বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ, লাভ-অলাভের উর্ধ্বে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাষ্ট্রদূত হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আহমদ ছফা সেই প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সবসময় সম্মাননা, স্বীকৃতি এবং পুরস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন। সে কারণে ১৯৭৫ সালে তিনি লেখক শিবির সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ফিরিয়ে দেন বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার। জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি একুশে পদকটিও নিতে অস্বীকৃতি জানান, যেটি রাষ্ট্র তাঁকে দিতে পেরেছিল তাঁর মৃত্যুর পর। তিনি কখনো অনুকম্পা কিংবা কারো করুণা প্রত্যাশী ছিলেন না। আজকের অনুষ্ঠানে তাঁর নামে চন্দনাইশে সড়ক কিংবা সেতুর নামকরণের যে আকুতি ঝরে পড়ছে তাতে করে আহমদ ছফার আত্মা কষ্ট পাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। কারণ শুধু চন্দনাইশ নয়, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছড়িয়ে আছে আহমদ ছফার অমর সৃষ্টি। তাই জাতীয়ভাবেই আহমদ ছফার স্মৃতি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে চন্দনাইশ পৌরসভার মেয়র মাহবুবুল আলম খোকা স্কুলজীবনে চন্দনাইশের যে সড়ক দিয়ে আহমদ ছফা যাতায়াত করতেন সে সড়কটি তাঁর নামে নামকরণের ঘোষণা দেন। একইভাবে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ‘আহমদ ছফা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠাসহ তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা ও অধ্যয়নের দ্বার উন্মোচন করা হবে বলে জানান পৌর মেয়র।

অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, আহমদ ছফা কেবল চন্দনাইশের সন্তান নন, তিনি পুরো বাংলাদেশের সন্তান। জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সব অনবদ্য, অমর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। জীবদ্দশায় তিনি কারো আনুকূল্য দয়া-দাক্ষিণ্য গ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব তিনি সানন্দে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আমাকে ধারণ করার ক্ষমতা আপনার সরকার এবং প্রশাসনের নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেয়া কম্বল ঠিকই তিনি মৃত্যু পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন। কোনো কাপড় তিনি বেশিদিন পরতেন না। অথচ শীত চলে যাওয়ার পর লন্ড্রি থেকে সেই কম্বল ওয়াশ করে এনে তালাবদ্ধ করে রাখতেন। এখানেই আহমদ ছফা ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর আনুকূল্য তিনি নেননি, কিন্তু তাঁর মমতা জড়ানো কম্বল ঠিকই নিয়েছেনে এবং তা সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন মৃত্যু অবধি।

একুশে/এসআর/এটি